Wednesday, December 31, 2025
spot_img
Homeবিজনেসট্রাম্পের শুল্কনীতিতে বিশ্ববাণিজ্যের মোড়

ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে বিশ্ববাণিজ্যের মোড়

বিশ্ববাণিজ্যে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস আগেই মিলেছিল। নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে তিনি শুল্ক বাড়াবেন। সেই ঘোষণার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই, যখন চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়। একই সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়, কোন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কত বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে তা নিরূপণ করে সে অনুযায়ী পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রস্তুতি নিতে।

২০২৫ সালের ২ এপ্রিল ট্রাম্প প্রশাসন একযোগে বিশ্বের ১৫৭টি দেশের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্ত বিশ্ববাণিজ্যে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যেই সেই অতিরিক্ত শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। ওই সময়সীমায় বিভিন্ন দেশকে আলোচনার সুযোগ দেওয়া হয়, যা কার্যত বাণিজ্যনীতিকে কূটনৈতিক চাপের হাতিয়ারে পরিণত করে।

এই সময় বিশ্বের একাধিক দেশের সরকারপ্রধান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন। প্রেসিডেন্ট নিজেও প্রকাশ্যে বলেন, বিশ্বনেতারা এখন চুক্তির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এসব মন্তব্যের পর চীন ছাড়া অন্যান্য দেশের ওপর আরোপিত পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়।

যেভাবে শুল্ক নির্ধারণ

ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল, কোনো দেশ মার্কিন পণ্যের ওপর যত শুল্ক আরোপ করে, যুক্তরাষ্ট্রও সেই দেশের পণ্যের ওপর ততটাই শুল্ক বসাবে। তবে ২ এপ্রিলের ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট জানান, পুরোপুরি সমান শুল্ক আরোপ করলে অনেক দেশ কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, চীন মুদ্রা কারসাজি ও বিভিন্ন বাণিজ্যবাধা মিলিয়ে মার্কিন পণ্যে প্রায় ৬৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, তাই যুক্তরাষ্ট্র তার প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করছে। একই নীতির আলোকে অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়। সব দেশের পণ্যে গড়ে ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়।

অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের উত্থান

দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের বহু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপ করে আসছিল। ভিয়েতনাম মার্কিন পণ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল, যার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ৪৫ শতাংশ শুল্ক বসায়। বাংলাদেশ মার্কিন পণ্যে ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় তাদের পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। ভারতের ক্ষেত্রে মার্কিন পণ্যে ৫২ শতাংশ শুল্কের বিপরীতে ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রকে পরাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করে এসব উচ্চ শুল্ক দীর্ঘদিন এক ধরনের মাশুল হিসেবে টিকে ছিল। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির বড় চালিকা শক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই কাঠামো মেনে নিতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, এত দিন যুক্তরাষ্ট্রকে অন্য দেশগুলো অন্যায্যভাবে সুবিধা নিয়েছে, কিন্তু সেই সময় শেষ। ২ এপ্রিলকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন।

আলোচনার পর কী হলো

৯ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ৯০ দিনের স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হয় ৯ জুলাই। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে শুল্কহার পুনর্নির্ধারণ করা হয়। অন্য দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানিতে শুল্ক সমন্বয় করে এবং বাণিজ্যঘাটতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য কেনা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুরুতে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলেও আলোচনার পর তা কমিয়ে ২০ শতাংশে নামানো হয়। আগে বাংলাদেশের পণ্যে গড় শুল্কহার ছিল ১৫ শতাংশ। নতুন ব্যবস্থায় গড় হার দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশ, যদিও পণ্যভেদে শুল্ক আলাদা থাকে।

নির্বাহী আদেশ ও দেশভিত্তিক শুল্ক

আগস্ট মাসে জারি করা নির্বাহী আদেশে যুক্তরাষ্ট্র দুই স্তরের শুল্ক কাঠামো নির্ধারণ করে। যেসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ককে ন্যায্য মনে করা হয়েছে, তাদের জন্য শুল্ক ১০ শতাংশ। অন্যদের জন্য ১৫ শতাংশ বা তার বেশি। এই উচ্চ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে দেশগুলোর আচরণ ও আলোচনার অগ্রগতির ভিত্তিতে।

এই কাঠামো অনুযায়ী যুক্তরাজ্য ও ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের জন্য শুল্ক ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে মোট শুল্কহার ১৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান ও ভিয়েতনামের জন্য শুল্ক নির্ধারিত হয় ২০ শতাংশ। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের জন্য ২৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়।

ব্রাজিল ও ভারতের ক্ষেত্রে প্রথমে অপেক্ষাকৃত কম শুল্ক থাকলেও রাজনৈতিক টানাপোড়েন বাড়লে উভয় দেশের ওপর শাস্তিমূলক ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। ভারতের ওপর রাশিয়ার তেল কেনার কারণে অতিরিক্ত শুল্ক বসানো হলে দেশটি রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগী হয়। বিপরীতে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উষ্ণ হতে দেখা যায়, যা বাণিজ্যনীতির সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির ঘনিষ্ঠ সংযোগকে স্পষ্ট করে।

শুল্কযুদ্ধের বাস্তবতা ও প্রভাব

ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্যঘাটতির যুক্তি পুরোপুরি নিরপেক্ষ নয়। পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের সেবা খাতে বিপুল উদ্বৃত্ত রয়েছে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেবা বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ২৯৩ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।

অর্থনৈতিক বিকাশের ধারায় যুক্তরাষ্ট্র এখন সেবা ও প্রযুক্তিনির্ভর পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই বাস্তবতায় একতরফা শুল্ক আরোপ করে পুরোনো কাঠামো ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবুও এই শুল্কযুদ্ধ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বহুপক্ষীয় নীতিকে দুর্বল করেছে। নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থার বদলে শক্তিধর দেশের দর-কষাকষি প্রাধান্য পাচ্ছে।

এর ফলে বিশ্ববাণিজ্যে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। তবে অনেক দেশ নতুন বাণিজ্যচুক্তি করে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাল্টা উদ্যোগের কারণে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রভাব ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments