Wednesday, December 31, 2025
spot_img
Homeএডুকেশনট্রাম্প যুগে বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের তৃতীয় পথ

ট্রাম্প যুগে বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের তৃতীয় পথ

যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনা রয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ও গবেষকের অভিযোগ, দেশটির শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমেই এলিটবাদী হয়ে উঠছে এবং সমাজের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে তাদের সংযোগ দুর্বল হচ্ছে। তবে এই সমালোচনার মাঝেই একটি শিক্ষার্থী সংগঠন ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে। তারা মনে করে, সমস্যা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস নয়, বরং ভেতর থেকে রূপান্তরই হওয়া উচিত লক্ষ্য।

গত বসন্তে, যখন তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা তহবিল স্থগিত করছিল এবং হাজারো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছিল, তখন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার পক্ষে আয়োজিত একটি প্রতিবাদে অংশ নেন। এই অবস্থান তাঁর কাছে সহজ ছিল না। কারণ তিনি দীর্ঘদিন ধরেই নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে একধরনের অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তাঁর চোখে, প্রতিষ্ঠানটি আশপাশের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর প্রতি উদাসীন এবং অতিরিক্তভাবে এলিট শ্রেণিকেন্দ্রিক। তিনি একদিকে উচ্চশিক্ষাকে রক্ষা করতে চেয়েছেন, অন্যদিকে বর্তমান কাঠামোকে নিঃশর্তভাবে সমর্থন করতেও পারেননি।

এই দ্বন্দ্ব থেকেই তাঁর যুক্ত হওয়া একটি তৃণমূল শিক্ষার্থী নেটওয়ার্কে, যা দুই বছর আগে গড়ে ওঠে। এই নেটওয়ার্কের লক্ষ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের এলিট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে ক্রমবর্ধমান সামাজিক বিভাজনে ভূমিকা রাখছে, তা সমালোচনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করা। সংগঠনটি বিশ্বাস করে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নাগরিক দায়িত্ব থেকে সরে এসেছে। তারা চায়, এসব প্রতিষ্ঠান আবারও জনস্বার্থে শিক্ষাদানের মূল আদর্শে ফিরে যাক।

এই অবস্থান অনেক ক্ষেত্রে ডানপন্থী রাজনৈতিক সমালোচনার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ শোনালেও সংগঠনটির দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার ওপর আক্রমণ চালিয়ে একে দুর্বল করতে চায়, সেখানে এই শিক্ষার্থী গোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা করতে চায়, তবে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে। তাদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভাঙার বদলে নতুনভাবে গড়ে তোলাই ভবিষ্যতের পথ।

গত নভেম্বর মাসে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত একটি সম্মেলনে এই নেটওয়ার্কের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ও সদ্য স্নাতক অংশ নেন। সেখানে তারা একটি নতুন ‘একাডেমিক সামাজিক চুক্তি’ তৈরির কাজ শুরু করেন। এই খসড়া নথির উদ্দেশ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষা কাদের জন্য এবং কীভাবে কাজ করবে, তা নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা। নথিতে বলা হয়, এলিট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয় বিশেষাধিকারভিত্তিক দুর্গ হয়ে থাকবে, নয়তো উচ্চশিক্ষায় একটি নতুন জাগরণে ভূমিকা রাখবে। জনসাধারণের বিনিয়োগের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে হলে এসব প্রতিষ্ঠানকে তাদের সম্পদ, প্রভাব ও মর্যাদা জনকল্যাণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।

সংগঠনটির নেতাদের মতে, বর্তমান বাস্তবতায় দুটি চরম অবস্থানের বাইরে চিন্তা করা জরুরি। একদিকে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের আহ্বান, অন্যদিকে রয়েছে অপরিবর্তিত কাঠামো রক্ষার চেষ্টা। তারা একটি তৃতীয় পথের কথা বলছেন, যেখানে সমালোচনা ও সমর্থন পাশাপাশি চলবে এবং একটি উন্নত ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

এই সংগঠনের জন্ম ২০২৩ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক বৈষম্যের বিরুদ্ধে রায় দেয়। সেই সময় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী দীর্ঘদিনের হতাশা থেকে বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাঁর অভিজ্ঞতায়, এলিট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বহুমুখী সুযোগের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে অনেক শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও পরামর্শক পেশার মতো সংকীর্ণ করপোরেট পথে ঠেলে দেয়। তিনি দেখেছেন, সমাজসেবামূলক কাজের প্রতি আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য ভিন্ন পথে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

এই বিশ্লেষণ থেকেই সংগঠনটি বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মতামত শোনার উদ্যোগ নেয়। সেখানে সবচেয়ে বেশি উঠে আসে দুটি অভিযোগ। এক, ধনী ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানদের জন্য বিশেষ সুবিধা। দুই, স্নাতকদের বড় একটি অংশকে এমন পেশায় প্রবাহিত করা, যার সমাজে প্রত্যক্ষ ইতিবাচক প্রভাব সীমিত।

এই আন্দোলনের প্রভাব ইতোমধ্যেই কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় উত্তরাধিকারভিত্তিক ভর্তি প্রক্রিয়া নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে এই প্রচারণার ভূমিকা ছিল বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। যদিও কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি নিয়ে সেই নীতি বজায় রেখেছে। একই ধরনের সংস্কার দাবিতে কানেকটিকাট, রোড আইল্যান্ড ও ম্যাসাচুসেটসেও প্রচেষ্টা চলছে। পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মজীবন পরামর্শ ব্যবস্থাকে বৈচিত্র্যময় করার দাবিও জোরালো হয়েছে। ম্যাসাচুসেটসের একটি কলেজে শিক্ষার্থীদের চাপেই প্রশাসন জনস্বার্থমূলক পেশার জন্য সহায়তা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে।

দুই বছরের মধ্যে এই সংগঠনের বিস্তার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। শুরুতে এক ডজন ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী যুক্ত হলেও এখন ৭৬টির বেশি ক্যাম্পাসে তাদের কার্যক্রম রয়েছে। তারা আনুষ্ঠানিক অধ্যায়ভিত্তিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে।

সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই মনে করেন, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক চাপ তাদের বার্তাকে আরও প্রাসঙ্গিক করেছে। তবে তারা রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে থেকে বিভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের একত্র করতে চায়। মুক্ত মতপ্রকাশ ও ভর্তি নীতির মতো বিষয়ে ভিন্ন রাজনৈতিক মতের শিক্ষার্থীরাও একমত হতে পারেন বলে তাদের বিশ্বাস।

এই শিক্ষার্থী গোষ্ঠীর প্রস্তাবিত সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি মূলত প্রগতিশীল। তারা চায় ভর্তি প্রক্রিয়ায় এলিটবাদ কমুক, শিক্ষার্থীদের পরিচালনা পর্ষদে প্রতিনিধিত্ব বাড়ুক এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে আরও জবাবদিহিমূলক হোক। একই সঙ্গে তারা একাডেমিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার ওপর জোর দিচ্ছে।

অনেকে মনে করেন, বর্তমান সংকট যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষার জন্য এক ধরনের সুযোগও বটে। যখন অনিশ্চয়তা ও মতভেদ তীব্র, তখনই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সবাইকে আলোচনার টেবিলে আনা সম্ভব। এই শিক্ষার্থী আন্দোলনের লক্ষ্য হলো এমন একটি ভবিষ্যৎ কল্পনা করা, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গণতন্ত্রের দায়িত্বশীল অভিভাবক হিসেবে কাজ করবে এবং দেশের অধিকাংশ মানুষের স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করবে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments