শীতল যুদ্ধের সময় মহাকাশ দৌড় ছিল মূলত রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের একটি মাধ্যম। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপোলো অভিযানের মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে চাঁদে মানুষের প্রথম অবতরণের পর ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যকার সেই প্রতিযোগিতা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে ২০২৬ সাল থেকে আবারও শুরু হতে যাচ্ছে নতুন এক মহাকাশ প্রতিযোগিতা, যা বাহ্যত শান্তিপূর্ণ অনুসন্ধানের নামে হলেও বাস্তবে নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চল, যেখানে সূর্যের আলো প্রায় স্থায়ীভাবে পাওয়া যায় এবং সূর্যালোকবিহীন গহ্বরে বরফের অস্তিত্ব রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব সম্পদ ভবিষ্যৎ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও মহাকাশ অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের নেতৃত্বাধীন একটি জোট চাঁদের পৃষ্ঠে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে মহাকাশকে মানবজাতির একটি যৌথ সম্পদ হিসেবে দেখা হলেও ১৯৬৭ সালের জাতিসংঘের আউটার স্পেস চুক্তিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানা নিষিদ্ধ থাকলেও বেসরকারি মালিকানা বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এই অস্পষ্টতাই এখন বড় বড় শিল্পপতি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য সুযোগ তৈরি করছে। লক্ষ্য একটাই, আগে দখল নেওয়া, নিয়মকানুন নির্ধারণ করা এবং অন্যদের আপত্তিকে উপেক্ষা করা। আগামী বছর নাসার আর্টেমিস টু এবং চীনের চাং’ই সেভেন মিশনের মাধ্যমে এই প্রতিযোগিতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
মহাকাশ বাণিজ্যিকীকরণকে ত্বরান্বিত করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার নাসার বাজেট কমিয়ে আনছে, যা ১৯৬১ সালের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওয়াশিংটনের নীতিগত অবস্থান হলো মহাকাশ অভিযানে রাষ্ট্রের ভূমিকা কমিয়ে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আনা। এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যায় আর্টেমিস চুক্তিতে, যা ইতিমধ্যে ৪০টিরও বেশি দেশ স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীর মালিকানা কাঠামোকে মহাকাশে সম্প্রসারণের একটি কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে, যা প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের কাছে আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হচ্ছে।
অন্যদিকে চীন ও রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক লুনার রিসার্চ স্টেশন একটি রাষ্ট্রনির্ভর মডেলের প্রতিনিধিত্ব করছে। এই জোটের দাবি, তাদের প্রকল্প আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে পরিচালিত হবে এবং কোনো একক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। তারা বলছে, জাতিসংঘের নিয়মকানুন মেনেই এই উদ্যোগ এগোবে।
ফলে চাঁদকে ঘিরে দুটি ভিন্ন শিবিরের মধ্যে প্রতিযোগিতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উভয় পক্ষই শান্তিপূর্ণ অনুসন্ধানের কথা বললেও বাস্তবে তারা চাঁদের সম্ভাব্য সম্পদ দখলের কৌশলগত লড়াইয়ে নেমেছে। পানি থেকে জ্বালানি উৎপাদন, মানব বসতি টিকিয়ে রাখা কিংবা নির্মাণকাজে চাঁদের পাথরের ব্যবহার নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। এসব ধারণার অনেকটাই এখনো তাত্ত্বিক পর্যায়ে থাকলেও সরকারগুলো ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে বিপুল ব্যয়ের যৌক্তিকতা দেখাতে চাইছে।
চাঁদে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে প্রতিযোগিতা তুলনামূলকভাবে বাস্তবসম্মত। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন-রাশিয়া উভয় পক্ষই মানব বসতি টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় ছোট আকারের পারমাণবিক চুল্লির নকশা ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি পক্ষ পাঁচ বছরের মধ্যে এবং অন্য পক্ষ ২০৩৫ সালের মধ্যে এই ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। চাঁদের দীর্ঘ ১৪ দিনের রাত মোকাবিলায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ছাড়া স্থায়ী বসতি সম্ভব নয়। এই প্রযুক্তি একবার সফল হলে ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহেও প্রয়োগ করা যেতে পারে।
১৯৯২ সালে জাতিসংঘ মহাকাশে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করলেও সেখানে নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামোর অভাব রয়েছে। যে দেশ বা জোট নির্ভরযোগ্য মহাকাশভিত্তিক জ্বালানি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে, তারা ভবিষ্যৎ শতাব্দীর শিল্প ও ডিজিটাল শক্তির ভারসাম্য নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
পৃথিবী ছাড়ার এই তাড়নাকে অনেক সময় মানবজাতির অনুসন্ধিৎসু মনোভাবের ফল হিসেবে দেখা হয়। তবে এর পেছনে আরও একটি বাস্তব কারণ রয়েছে। মানবসভ্যতা বর্তমানে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে গ্রহটির পুনরুৎপাদন ক্ষমতার তুলনায় প্রায় ১.৭ গুণ বেশি চাপ সৃষ্টি করছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার তিনটি পথ সামনে আসে। দক্ষতা বাড়ানো, পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক রূপান্তর অথবা শক্তিনির্ভর কার্যক্রমকে পৃথিবীর বাইরে সরিয়ে নেওয়া।
প্রযুক্তি খাতের একটি বড় অংশ তৃতীয় পথটিকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কক্ষপথে সৌরশক্তিচালিত ডেটাসেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা ইতিমধ্যে আলোচনায় এসেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চাহিদা ও বিদ্যুতায়ন দ্রুত বাড়তে থাকায় পৃথিবীর বিদ্যুৎব্যবস্থা চাপের মুখে পড়ছে। এই বাস্তবতায় মহাকাশভিত্তিক শক্তি ব্যবস্থার আকর্ষণ বাড়ছে। বাস্তব প্রয়োজন থেকে শুরু হওয়া এই উদ্ভাবন শেষ পর্যন্ত নতুন ধরনের সম্পদ আহরণের পথে নিয়ে যেতে পারে।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতেও এই আশঙ্কার প্রতিফলন দেখা যায়। সেখানে দেখানো হয়, নতুন গ্রহে পা রেখেও মানুষ পুরোনো রাজনীতি ও ক্ষমতার লড়াই বহন করে নিয়ে যায়। বাস্তব ক্ষেত্রেও আজ মহাকাশ আইন এমনভাবে গড়ে উঠছে, যা শান্তিপূর্ণ বাণিজ্যের আড়ালে সম্পদ দখলের সুযোগ তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৫ সালের মহাকাশ আইন গ্রহাণু খননের অনুমতি দিয়ে এই প্রবণতাকে আরও জোরদার করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে, নতুন গ্রহে যাওয়ার আগে কি মানবজাতির উচিত নয় নিজের গ্রহে টেকসইভাবে বাঁচার পথ খুঁজে নেওয়া। চাঁদ ও মঙ্গলের দিকে অগ্রযাত্রা যদি পুরোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি হয়, তবে তার পরিণতি হতে পারে আরও ভয়াবহ।



