রাতের অন্ধকার তখনও পুরোপুরি কাটেনি। বেইজিংয়ের উপকণ্ঠে বিস্তীর্ণ তৃণভূমির নীরবতার ভেতর এক স্বেচ্ছাসেবী নিরবে চোখ রাখছিলেন চারপাশে। শহরের আলো তখনো দূরে, পেছনে ঘুমিয়ে থাকা মহানগর। তৃণভূমির বুক চিরে হালকা বাতাস বইছে, আর সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে শোনা যাচ্ছিল শুধু শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। ভোরের আলো ফোটার আগেই শুরু হয় তাঁর প্রতিদিনের ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান। উদ্দেশ্য একটাই, অবৈধ শিকারিদের হাত থেকে পরিযায়ী ও দুর্লভ পাখিদের বাঁচানো।
সূর্য ওঠার আগমুহূর্তে হঠাৎ পায়ের শব্দে সতর্ক হয়ে ওঠেন তিনি। শিকারিরা ইতোমধ্যেই এলাকায় ঢুকে পড়েছে। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তিনি ঘন ঝোপঝাড় পেরিয়ে একটি খোলা জায়গায় পৌঁছান। সেখানে চোখে পড়ে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পাতা একটি জাল, যা কাছে না গেলে বোঝাই যায় না। সেই জালের মাঝখানে আটকে ছিল একটি পরিযায়ী পাখি, মুক্ত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়ছিল সুতার ফাঁসে।
চীনে প্রতিবছর এভাবেই হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি ধরা পড়ে। কখনো পোষা প্রাণীর বাজারে, কখনো আবার মাংসের জন্য এসব পাখি কালোবাজারে বিক্রি হয়। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এই অবৈধ ব্যবসা অনেকের কাছে কম পুঁজিতে বেশি লাভের পথ হয়ে উঠেছে। একটি দুর্লভ প্রজাতির পাখির দাম অনেক সময় একজন কৃষকের মাসিক আয়ের চেয়েও বেশি হয়ে থাকে। এই লোভই শিকারিদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে।
এই বাস্তবতার বিরুদ্ধেই গত এক দশক ধরে একাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ওই স্বেচ্ছাসেবী। তাঁর ভাষায়, মানুষের দখলে থাকা এই পৃথিবীতে অন্তত পাখিদের জন্য কিছুটা নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তাঁর লক্ষ্য। পাখির প্রতি ভালোবাসা তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শৈশব থেকেই তিনি প্রকৃতির সঙ্গে বড় হয়েছেন। নব্বইয়ের দশকের বেইজিংয়ে শহরের প্রান্তে তৃণভূমি, পাখি, ব্যাঙ আর সাপ দেখা ছিল স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু দুই হাজার সালের পর দ্রুত নগরায়ণ সবকিছু বদলে দেয়। একের পর এক ভবন গড়ে ওঠে, হারিয়ে যায় প্রাকৃতিক আবাসস্থল। এই পরিবর্তন তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয় এবং সেখান থেকেই বন্য প্রাণী সংরক্ষণের পথে নামেন তিনি।
শিকারিদের ধরিয়ে দিতে নিজের জমানো অর্থ ব্যয় করে তিনি গড়ে তোলেন একটি স্বেচ্ছাসেবী দল। শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব অপরাধকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও ধারাবাহিক চাপ ও তথ্যের ভিত্তিতে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলায়। তবে এই পথ মোটেও সহজ ছিল না। একাধিকবার হামলার শিকার হয়েছেন তিনি। এমনকি বড় এক অবৈধ পাখি ব্যবসায়ীর হাতে মারও খেতে হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতা ও ঝুঁকির কারণে এখন আর কেউ তাঁর সঙ্গে নিয়মিত কাজ করেন না। বর্তমানে তিনি একাই অভিযান চালান।
আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় তিনি শিকারিদের চলাচলের সম্ভাব্য পথ শনাক্ত করেন। তাঁর মতে, পাখি পোষা চীনের একটি পুরোনো ঐতিহ্য হলেও এর আড়ালে যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলছে, তা অনেকেই উপলব্ধি করেন না। বিশেষ করে বয়স্কদের কাছে এটি আভিজাত্যের প্রতীক হলেও এর প্রকৃত মূল্য পাখির জীবন দিয়ে দিতে হচ্ছে।
বেইজিংয়ের একটি নদীর ধার ঘেঁষে গড়ে ওঠা অবৈধ বাজারে এই চিত্র আরও স্পষ্ট। ফুটপাতে অস্থায়ী দোকানে নানা পণ্যের পাশাপাশি গোপনে বিক্রি হয় খাঁচাবন্দী পাখি। পথচারীদের কাছে ফিসফিস করে বিরল প্রজাতির কথা বলে উচ্চমূল্য হাঁকা হয়। পার্কের ভেতরে একদিকে নাচের মহড়া, অন্যদিকে খাঁচা হাতে আড্ডা দেওয়া মানুষের ভিড়। এই চেনা দৃশ্যেই হঠাৎ পুলিশের উপস্থিতি সবকিছু থামিয়ে দেয়। নাম ঠিকানা নথিভুক্ত শুরু হলে অনেকেই অজুহাত দেন যে তাঁরা শুধু পাখি নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছেন।
এ বছর দেশটির জননিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ বন্য প্রাণী রক্ষায় বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যমতে, অবৈধ বন্য প্রাণী বাণিজ্য বিশ্বব্যাপী বিশাল অঙ্কের বাজার। দীর্ঘদিন ধরেই চীনকে এই বাণিজ্যের বড় ভোক্তা হিসেবে দেখা হতো। তবে আন্তর্জাতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ নীতিগত পরিবর্তনের ফলে এখন নিষেধাজ্ঞা ও নজরদারি জোরদার করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমেও বন্য পাখি রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে। এর ফলেই স্বেচ্ছাসেবীরা আগের চেয়ে বেশি সহযোগিতা পাচ্ছেন।
সাম্প্রতিক এক অভিযানে আটক শিকারির মোবাইল ফোন ঘেঁটে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ চিত্র। সেখানে খাঁচাবন্দী অসংখ্য পাখির ছবি ও ভিডিও পাওয়া যায়। পরে তাঁর বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় বিক্রির অপেক্ষায় থাকা আরও পাখি। অন্য এক শহরে বড় অভিযানে হাজার হাজার সংরক্ষিত পাখি উদ্ধার এবং একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তবে শাস্তির মাত্রা এখনো অপর্যাপ্ত বলে মনে করেন এই স্বেচ্ছাসেবী। তবু তিনি আশাবাদী। গত দশ বছরে তাঁর হাতে উদ্ধার হয়েছে বিশ হাজারের বেশি পাখি, ধ্বংস হয়েছে অসংখ্য ফাঁদ। তাঁর বিশ্বাস, নতুন প্রজন্ম যখন জীববৈচিত্র্যের মূল্য বুঝবে, তখনই প্রকৃত পরিবর্তন আসবে। আদর্শের জায়গা থেকে তিনি এখনো অবিচল।



