Monday, December 29, 2025
spot_img
Homeসম্পাদকীয়উৎসবের সময়ে শান্তি ও আশার বার্তা

উৎসবের সময়ে শান্তি ও আশার বার্তা

বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, সংঘাত ও অনিশ্চয়তার এই সময়ে শান্তি, আশা ও মানবিকতার বার্তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক পল টিলিখ তাঁর জীবনের শেষ দিকের এক উপদেশে একটি গভীর প্রশ্ন তুলেছিলেন, মানুষের কি আশার অধিকার আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনীর সঙ্গে সেনা যাজক হিসেবে কাজ করা এবং নাৎসি জার্মানি থেকে শরণার্থী হয়ে পালিয়ে আসা এই চিন্তাবিদ বিংশ শতাব্দীর ভয়াবহতা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তবুও ১৯৬৫ সালে দেওয়া সেই বক্তব্যে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, মানুষ আশা ছাড়া বাঁচতে পারে না, এমনকি সেই আশার পথ যদি কষ্টকর ও সাহসিকতার পরীক্ষায় ভরা হয় তবুও।

আজ থেকে প্রায় ষাট বছর পর বর্তমান সময়েও একই ধরনের দৃঢ় আশাবাদ প্রয়োজন। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের চতুর্থ বার্ষিকী ঘনিয়ে আসছে। পশ্চিমা উদার গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভেতরেও অন্ধকার রাজনৈতিক শক্তি সামাজিক বন্ধনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। একই সঙ্গে বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ফলে বিশ্ব আরও অস্থির ও হুমকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

শান্তি গবেষণা সংস্থার জুনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে রাষ্ট্রভিত্তিক সংঘাতের সংখ্যা ১৯৪৬ সালের পর যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি ছিল। গাজায় অক্টোবরে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা কিছুটা স্বস্তি এনেছে, তবে ধ্বংসস্তূপের ভেতর বসবাসকারী মানুষেরা এখনো খাদ্যের তীব্র সংকটে ভুগছে এবং শীতের নির্মমতার মুখে অসহায় অবস্থায় রয়েছে। সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। বরং বাইরের শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে এই সংঘাতকে আরও উসকে দিচ্ছে।

অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যে সংঘটিত সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলা এবং ব্রিটিশ ভূখণ্ডে আরেকটি হামলার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে যে, গাজায় হামাসের হামলা ও পরবর্তী যুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযানের পর বিশ্বজুড়ে ইহুদিবিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউরোপজুড়ে সংঘাতের আশঙ্কা এখন আশির দশকের শীতল যুদ্ধকালীন সময়ের পর সবচেয়ে তীব্র। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যে এক নতুন অনিশ্চয়তার যুগের কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে রাশিয়া ও অন্যান্য শত্রু রাষ্ট্র আধুনিক হাইব্রিড যুদ্ধকৌশল উন্নত করছে। ন্যাটোর মহাসচিবের সাম্প্রতিক বক্তব্যে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর রুশ হামলার আশঙ্কার কথা উঠে আসায় সময়ের উদ্বেগ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তবুও এই অন্ধকার সময়ের মাঝেও মানবতার আলোকিত দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়ার এক সৈকতে বন্দুকধারীর মোকাবিলায় এক ইহুদি দম্পতি ও এক মুসলিম ব্যক্তির আত্মত্যাগ ও সাহস বিশ্ববাসীকে অনুপ্রাণিত করেছে। একইভাবে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রুশ গোলাবর্ষণের মধ্যেও ইউক্রেনের জনগণের দৃঢ়তা ও সহনশীলতা আশার প্রতীক হয়ে আছে।

সুদানে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কমিউনিটি রান্নাঘর চালু রেখেছেন, যা ভয়াবহ খাদ্য সংকটে থাকা মানুষের জন্য জীবনরক্ষাকারী সহায়তা হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক বেতার ভাষণে পল টিলিখ বলেছিলেন, ভালোবাসা ব্যক্তিস্বার্থ ও জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ দেয়াল ভেঙে অন্য মানুষের কাছে পৌঁছায়, ভাষা বা বর্ণের ভিন্নতা সত্ত্বেও।

এই মানবিক ঐক্যের শক্তি আরেকভাবে অনুভূত হবে, যখন লাখো মানুষ ক্যামব্রিজের একটি ঐতিহ্যবাহী বড়দিনের প্রার্থনায় অংশ নেবে। নয়টি পাঠ ও ক্যারলের এই আয়োজন বহু পরিবারের কাছে শান্তি ও শুভেচ্ছার মৌসুমের প্রকৃত সূচনা হিসেবে বিবেচিত। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই অনুষ্ঠানটির জন্মও হয়েছিল যুদ্ধের ভয়াবহ পটভূমিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে এক সেনা যাজকের উদ্যোগে এর সূচনা হয়। তখন যেমন, আজও তেমনি বিশ্ব অন্ধকারের ভেতর আশার আলো খুঁজছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments