চলতি বছর বিশ্ববাজারে মার্কিন ডলারের জন্য সময়টা অনুকূল যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে ডলারের বিনিময় হার ধারাবাহিকভাবে কমছে, অন্যদিকে সোনার দাম দ্রুত বাড়ছে। অর্থনীতিতে এই দুই সম্পদের মধ্যে সাধারণত বিপরীতমুখী সম্পর্ক দেখা যায়। ডলার দুর্বল হলে বিনিয়োগকারীরা সোনার দিকে ঝুঁকে পড়েন, আর সেটিই এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বিশ্বের প্রধান ছয়টি মুদ্রার বিপরীতে ডলারের অবস্থান পরিমাপের জন্য যে ডলার ইনডেক্স ব্যবহার করা হয়, সেটি বর্তমানে আড়াই মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ডলার ইনডেক্সের মান দাঁড়িয়েছে ৯৭ দশমিক ৭৬৭। এই সূচকের গতিপ্রকৃতি বলছে, চলতি বছর শেষে ডলারের মান প্রায় ৯ দশমিক ৯ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এমনটি হলে ২০০৩ সালের পর এটিই হবে ডলারের সবচেয়ে বড় বার্ষিক দরপতন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডলারের এই দুর্বলতার পেছনে অন্যতম বড় কারণ হলো মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত। চলতি বছর ফেড একাধিক দফায় নীতি সুদহার হ্রাস করেছে। বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশের ধারণা, আগামী বছরেও এই ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রান্তিকে প্রত্যাশার চেয়ে ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে, তবুও সুদহার কমার সম্ভাবনা বিনিয়োগকারীদের ভাবনায় বড় জায়গা করে নিয়েছে।
চলতি বছর ডলারের দামে ব্যাপক ওঠানামা লক্ষ্য করা গেছে। এর পেছনে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও নীতিগত অনিশ্চয়তাও বড় ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নীতিগত অবস্থান ও বক্তব্যের কারণে বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। একই সঙ্গে ফেডারেল রিজার্ভের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ছে কি না, তা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এর ফলে ফেডের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ে, যা সরাসরি ডলারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
বহুজাতিক এইচএসবিসি ব্যাংকের বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ডিসেম্বর মাসে ডলারের দুর্বলতার কারণ শুধু নীতি সুদহার নয়। ফেডের স্বাধীনতা নিয়ে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তাও বড় একটি কারণ। একই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তুলনামূলকভাবে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। কোথাও কোথাও নীতি সুদহার বাড়ানোর ইঙ্গিতও মিলছে। ফলে বৈশ্বিক বিনিয়োগের প্রবাহ ধীরে ধীরে ডলার থেকে সরে যাচ্ছে।
এর বিপরীতে ইউরোর শক্তিশালী অবস্থান চোখে পড়ার মতো। চলতি বছর ইউরোর মান প্রায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে ইউরো বর্তমানে তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। এক ইউরোর বিনিময়ে এখন প্রায় ১ দশমিক ১৮০৬ ডলার পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ ডলার যেখানে ২০০৩ সালের পর সবচেয়ে দুর্বল অবস্থার দিকে এগোচ্ছে, সেখানে ইউরো একই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে।
ইউরোর এই শক্তির পেছনেও নীতিগত কারণ রয়েছে। সম্প্রতি ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছে। এই ঘোষণার পর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ইউরোর প্রতি আরও বেড়েছে।
ইউরোর পাশাপাশি পাউন্ডের মানও গত তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। অস্ট্রেলীয় ও নিউজিল্যান্ড ডলারের মানও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখাচ্ছে। তবে জাপানের মুদ্রা ইয়েন তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশের বাজারে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। কয়েক মাস ধরে দেশের মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। বর্তমানে প্রতি ডলারের বিপরীতে ১২২ টাকার কিছু বেশি লেনদেন হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, নীতি সুদহারের সঙ্গে ডলারের শক্তির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ফেড যখন সুদহার কমায়, তখন ডলারে বিনিয়োগের আকর্ষণ কমে যায়। সুদ কম মানে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ড ও আর্থিক সম্পদে বিনিয়োগ থেকে মুনাফা কম পাওয়া। ফলে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা বেশি লাভের আশায় অন্য দেশের মুদ্রা ও বাজারে বিনিয়োগ বাড়ান। এতে ডলারের চাহিদা কমে যায় এবং সরবরাহ বৃদ্ধির প্রত্যাশা তৈরি হয়। এই সব মিলিয়ে ডলারের মান দুর্বল হয়।
ডলারে বিনিয়োগ কম আকর্ষণীয় হয়ে উঠলে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ সম্পদ হিসেবে সোনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। চলতি বছর সোনার দাম প্রায় ৬৮ শতাংশ বেড়েছে, যার বড় কারণ হিসেবে ডলারের শক্তিক্ষয়কে দেখা হচ্ছে।
ডলারের দুর্বলতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কিছুটা স্বস্তির বার্তাও নিয়ে আসে। বিশ্ববাজারে ডলার দুর্বল হলে এসব দেশের ডলারে নেওয়া ঋণের বোঝা তুলনামূলকভাবে হালকা হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমে এবং আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে থাকায় মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়া সহজ হয়। পাশাপাশি বেশি মুনাফার আশায় বিনিয়োগকারীরা উন্নয়নশীল দেশের বাজারে পুঁজি বিনিয়োগে আগ্রহী হন, যা এসব অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়।



