Sunday, December 28, 2025
spot_img
Homeআপনার স্বাস্থ্যরেটিনায় চিপে ফিরছে দৃষ্টির আলো

রেটিনায় চিপে ফিরছে দৃষ্টির আলো

চোখের দৃষ্টিশক্তি হারানো মানুষের জন্য আধুনিক বিজ্ঞান নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের উপকণ্ঠে বসবাসকারী এক অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকার অভিজ্ঞতা সেই আশার বাস্তব উদাহরণ হয়ে উঠেছে। বয়স ৮৭ বছর। প্রায় পাঁচ বছর আগে তাঁর চোখের দৃষ্টিক্ষেত্রের মাঝখানের অংশে ধীরে ধীরে ঝাপসা দেখা শুরু হয়। প্রথমে সেটি ছিল খুব ছোট একটি অস্পষ্ট বিন্দু। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই বিন্দু বড় হয়ে দাগে পরিণত হয় এবং একসময় পুরো দৃষ্টির কেন্দ্র দখল করে নেয়। এর ফলে মানুষের মুখ চিনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আশপাশে কে দাঁড়িয়ে আছে, সেটিও স্পষ্ট বোঝা সম্ভব হচ্ছিল না।

চিকিৎসকদের মতে, তিনি বয়সজনিত ম্যাকুলা অবক্ষয় রোগে আক্রান্ত হন। এটি এমন একটি জটিল রোগ, যেখানে চোখের রেটিনার ম্যাকুলা নামের গুরুত্বপূর্ণ অংশের কোষ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। এই ম্যাকুলাই মানুষের কেন্দ্রীয় দৃষ্টিশক্তির প্রধান নিয়ন্ত্রক। ফলে এ রোগে আক্রান্ত হলে পুরোপুরি অন্ধত্ব দেখা না দিলেও দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দৃষ্টিশক্তি মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে পড়ে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ কোটি মানুষ এই সমস্যায় ভুগছেন। দীর্ঘদিন ধরে এ রোগের কোনো কার্যকর চিকিৎসা ছিল না।

এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক একটি স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষামূলক উদ্যোগ নতুন আলো দেখাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি ‘প্রাইমা’ নামের একটি প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগীর চোখের রেটিনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি কম্পিউটার চিপ স্থাপন করেছে। এই চিপ বসানোর পর ওই শিক্ষিকা আবার বই ও পত্রিকা পড়তে পারছেন, যদিও মানুষের মুখ পুরোপুরি স্পষ্টভাবে দেখতে এখনো সক্ষম নন। তবু হারানো দৃষ্টির একটি অংশ ফিরে পাওয়াই তাঁর জীবনে বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, রেটিনায় বসানো চিপটির আকার মাত্র দুই মিলিমিটার। এতে রয়েছে প্রায় ৪০০টি সূক্ষ্ম ইলেকট্রোড। ম্যাকুলা অবক্ষয়ের কারণে যেখানে কোষ নষ্ট হয়ে গেছে, ঠিক সেই অংশেই চিপটি স্থাপন করা হয়েছে। চিপ বসানোর পর রোগীকে বিশেষ ক্যামেরাযুক্ত চশমা ব্যবহার করতে হয়। চশমার ক্যামেরা আশপাশের দৃশ্য ধারণ করে ইনফ্রারেড সংকেতের মাধ্যমে সরাসরি চিপে পাঠায়। সেই সংকেত চোখের স্নায়ু দিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। এর ফলে স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি ফিরে না এলেও অক্ষর, শব্দ ও কিছু দৃশ্য শনাক্ত করা সম্ভব হয়।

চিকিৎসকেরা বলছেন, ভবিষ্যতে আরও উন্নত চিপ তৈরি করা সম্ভব হবে, যেখানে ইলেকট্রোডের সংখ্যা কয়েক হাজারে উন্নীত করা যাবে। এতে দৃষ্টিশক্তির মান আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই ঘণ্টা বই বা পত্রিকা পড়তে পারছেন ওই রোগী। দীর্ঘদিন পর আবার পড়ার সুযোগ পাওয়াকে তিনি নিজের জীবনের বড় প্রাপ্তি হিসেবে দেখছেন। শিক্ষাজীবনে শিশুদের পড়ানোই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় আনন্দ। তাই নিজে আর পড়তে না পারার কষ্ট ছিল গভীর।

এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণায় আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী জানান, চিকিৎসার আগে রোগীরা এক মিটার দূর থেকেও চোখের চার্টের সবচেয়ে বড় অক্ষর পড়তে পারতেন না। প্রাইমা প্রযুক্তি ব্যবহারের পর তারা চার্টের পঞ্চম লাইনের লেখা পড়তে সক্ষম হয়েছেন। গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রায় ৮০ শতাংশ রোগীর দৃষ্টিশক্তিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। অনেকেই বাড়িতে বসে অক্ষর, সংখ্যা ও শব্দ পড়তে পারছেন।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬৮০টি প্রতিষ্ঠান মস্তিষ্ক ও কম্পিউটার সংযোগ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। এ ধরনের প্রযুক্তি ঘিরে যেমন ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে, তেমনি রয়েছে ভয় ও বিভ্রান্তি। অনেকের ধারণা, মস্তিষ্ক বা চোখে চিপ বসানো মানেই মানুষের চিন্তায় নজরদারি। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই আশঙ্কার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুবই সীমিত। বর্তমান গবেষণার মূল লক্ষ্য মানুষের হারানো সক্ষমতার কিছুটা ফিরিয়ে দেওয়া এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments