পৃথিবীতে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত রেডিও তরঙ্গ শুধু ভূপৃষ্ঠেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা ছড়িয়ে পড়ছে মহাকাশেও। এই রেডিও তরঙ্গের বিস্তার পৃথিবীর চারপাশে এক ধরনের অপ্রত্যাশিত বলয় বা সুরক্ষাবলয় তৈরি করেছে, যা মহাকাশে বিদ্যমান ক্ষতিকর বিকিরণের আচরণে পরিবর্তন আনছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, শক্তিশালী সৌরঝড়ের সময় এই বিকিরণ বলয়ে অস্থায়ী নতুন কাঠামো সৃষ্টি হয়, যা স্যাটেলাইট এবং নভোচারীদের জন্য ঝুঁকি বাড়াতে পারে। সংস্থাটির ভ্যান অ্যালেন প্রোবস নামের মহাকাশযান থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব পর্যবেক্ষণের কথা জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, বহু দশক ধরে সমুদ্রের গভীরে চলাচলকারী সাবমেরিনের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতে অত্যন্ত নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সির রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করা হচ্ছে। এত দিন ধারণা ছিল, এসব রেডিও তরঙ্গ পৃথিবীর কাছাকাছি স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এই তরঙ্গের একটি অংশ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে অনেক ওপরে মহাকাশে পৌঁছে যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে তারা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রে আটকে থাকা বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত কণার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করছে। এই প্রক্রিয়াটি ঘটছে ভূপৃষ্ঠ থেকে বহু দূরে অবস্থিত ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশন বেল্ট এলাকায়।
নতুন তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬০–এর দশকে করা পরিমাপের তুলনায় বর্তমানে পৃথিবীর চারপাশের বিকিরণ পরিবেশ উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। মানুষের তৈরি রেডিও তরঙ্গের ক্রমাগত ও ব্যাপক ব্যবহারের ফলে সেখানে একটি অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল কাঠামো গড়ে উঠেছে, যা আগে ছিল না। এই পরিবর্তন প্রমাণ করে যে আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি কেবল পৃথিবীর জীবনযাত্রাতেই নয়, মহাকাশ পরিবেশেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে।
ভ্যান অ্যালেন বেল্ট মূলত পৃথিবীর বিষুবীয় অঞ্চলের চারপাশে অবস্থান করা উচ্চ শক্তির চার্জযুক্ত কণা, বিশেষ করে ইলেকট্রন ও প্রোটনের দুটি বিশাল বলয়। পৃথিবীর শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র এই কণাগুলোকে ধরে রাখে। যদিও এই বলয় খালি চোখে দেখা যায় না, তবে এগুলোর শক্তি এতটাই বেশি যে স্যাটেলাইটের যন্ত্রাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং দীর্ঘ সময় সেখানে অবস্থান করা নভোচারীদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের তৈরি রেডিও তরঙ্গ ভ্যান অ্যালেন বেল্টের ভেতরের অংশে এক ধরনের বুদ্বুদ সদৃশ সীমানা তৈরি করেছে। এই সীমানা উচ্চ শক্তির বিকিরণ কণাগুলোকে পৃথিবীর আরও কাছাকাছি আসতে বাধা দেয় এবং কিছুটা দূরে ঠেলে রাখে। বিজ্ঞানীরা এটিকে সরাসরি শক্তির ঢাল বা ফোর্স ফিল্ড হিসেবে আখ্যা না দিলেও এর প্রভাব যে স্পষ্টভাবে পরিমাপযোগ্য, সে বিষয়ে একমত। এই পর্যবেক্ষণ মানুষের প্রযুক্তিগত কর্মকাণ্ডের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
যেখানে মানুষের তৈরি রেডিও সংকেত ধীরে ও ধারাবাহিকভাবে মহাকাশ পরিবেশে পরিবর্তন আনে, সেখানে সূর্য খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। ২০২৪ সালের মে মাসে পৃথিবীতে গত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সৌরঝড় আঘাত হানে। এর প্রভাবে মেরু অঞ্চলে নজরকাড়া অরোরা দেখা যায়, তবে একই সঙ্গে জিপিএস সংকেত সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ওই সময় নাসার স্যাটেলাইটে ধরা পড়ে, ভ্যান অ্যালেন বেল্টের দুই মূল বলয়ের মাঝখানে আরও দুটি অস্থায়ী বিকিরণ বলয় তৈরি হয়েছে। এই ঘটনা আবারও দেখিয়ে দিয়েছে, সৌর কার্যকলাপ ও মানুষের প্রযুক্তি মিলিয়ে পৃথিবীর চারপাশের মহাকাশ পরিবেশ ক্রমেই আরও জটিল হয়ে উঠছে।



