ডায়েট করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও অনেক নারী প্রায়ই লক্ষ্য করেন, পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি খেয়ে ফেলছেন। বিষয়টি শুধু ইচ্ছাশক্তির অভাবের কারণে ঘটে এমন নয়। নারীর শরীর ও জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা জৈবিক, মানসিক ও সামাজিক বাস্তবতা এই প্রবণতার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব কারণ বোঝা গেলে ডায়েট অনুসরণ করাও তুলনামূলক সহজ হয়ে ওঠে।
নারীর শরীরে মাসিক চক্রের সঙ্গে হরমোনের ওঠানামা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একটি মাসিক শুরু হওয়ার পর থেকে পরবর্তী মাসিক শুরু হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত সময়কে একটি পূর্ণ চক্র হিসেবে ধরা হয়। এই চক্রের বিভিন্ন ধাপে ভিন্ন ভিন্ন হরমোনের মাত্রা বাড়ে বা কমে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে ক্ষুধা ও খাবারের প্রতি আকর্ষণের ওপর। অনেক সময় হরমোনের প্রভাবে অতিরিক্ত মিষ্টি বা উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবারের প্রতি তীব্র আগ্রহ তৈরি হয়। ফলে মাসজুড়ে একই রকম ডায়েট মেনে চলা অনেক নারীর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
হরমোনজনিত এই পরিবর্তনের পাশাপাশি আবেগ, মানসিক চাপ ও বিষণ্নতাও অতিরিক্ত খাওয়ার একটি বড় কারণ। মন খারাপ, দুশ্চিন্তা বা মানসিক অস্থিরতার সময় অনেকেই খাবারের মধ্যে স্বস্তি খোঁজেন। পছন্দের খাবার খেলে শরীরে সুখ অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্কিত হরমোনের নিঃসরণ বাড়ে, যা সাময়িকভাবে মন ভালো করতে সাহায্য করে। বিষণ্নতায় ভুগলে বা দীর্ঘ সময় মানসিক চাপে থাকলে খাবারের প্রতি এই নির্ভরতা আরও বেড়ে যেতে পারে।
নারীদের ক্ষেত্রে আবেগগত এই দিকটি তুলনামূলক বেশি লক্ষ্য করা যায়। হরমোনের প্রভাবের কারণে নারীর আবেগের প্রকাশ ও ওঠানামা অনেক সময় বেশি হয়। এর পাশাপাশি সামাজিক বাস্তবতাও গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ পরিবারে রান্নাবান্না, ঘর সামলানো, সন্তান লালনপালন, বয়োজ্যেষ্ঠদের দেখভালসহ নানা দায়িত্ব মূলত নারীর ওপরই পড়ে। এমনকি গৃহকর্মী থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে পুরো ব্যবস্থাপনার দায়ভার নারীকেই নিতে হয়। এত কাজের পরও অনেক সময় এই পরিশ্রমের যথাযথ স্বীকৃতি মেলে না। এর ফলে মানসিক চাপ ও বিষণ্নতার ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা অতিরিক্ত খাওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
এ ছাড়া পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। অনেক নারী দৈনন্দিন কাজের চাপে ঠিকমতো বিশ্রাম নিতে পারেন না। কম ঘুম হলে শরীরের ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, যার ফলে খাবারের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়। এতে ডায়েট মেনে চলা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
সামাজিক চাপও ডায়েট ব্যর্থ হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। শরীরের গঠন বা ওজনের কারণে নারীরা অনেক সময় সমাজে তুলনামূলক বেশি সমালোচনার মুখে পড়েন। এই চাপ থেকে দ্রুত ফল পাওয়ার আশায় অনেকে নিজের শরীরের উপযোগিতা না ভেবেই কঠোর ডায়েট শুরু করেন। কেউ কেউ আবার এক বা একাধিক বেলার খাবার পুরোপুরি বাদ দেন। এই ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত শরীরে খাবারের ঘাটতি তৈরি করে এবং একসময় অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। বেশি খাওয়ার পর অপরাধবোধ তৈরি হয়, আর সেই অপরাধবোধ সামলাতে আবার খাবারের আশ্রয় নেওয়া হয়। এভাবে একটি চক্র তৈরি হতে পারে।
এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়েট অনুসরণ করা সবচেয়ে কার্যকর পথ। প্রতিটি মানুষের শরীর ও জীবনধারা ভিন্ন, তাই কোন কারণে কার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ হচ্ছে তা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি ডায়েট শুরু করার সময় মানসিক প্রস্তুতিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের চাপ বা সামাজিক তুলনার কারণে নয়, বরং নিজের সুস্থতার জন্য ডায়েট শুরু করলে তা দীর্ঘদিন ধরে রাখা সহজ হয়।
সব মিলিয়ে বলা যায়, নারীদের ক্ষেত্রে ডায়েটের সঙ্গে শুধু খাবারের হিসাব নয়, হরমোন, মানসিক অবস্থা ও সামাজিক বাস্তবতাকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন। এই বিষয়গুলো বোঝা গেলে ডায়েট করা আর অকারণে বেশি খেয়ে ফেলার দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমে আসতে পারে।



