যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবল ডিগ্রি অর্জনের জায়গা নয়। প্রতিটি ক্যাম্পাস যেন একটি পূর্ণাঙ্গ শহর, যেখানে শিক্ষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও বিনোদন একসঙ্গে মিশে আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এমন কিছু অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়, যা অনেকের কাছে ‘শুধু আমেরিকাতেই সম্ভব’ বলে মনে হয়। ফলে পর্যটকদের জন্যও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠছে আলাদা আকর্ষণের কেন্দ্র।
শরতের আগমনে, যখন ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করে এবং গাছের পাতা ঝরে পড়ে, তখন লাখো শিক্ষার্থী নতুন সেমিস্টারের জন্য ক্যাম্পাসে ফিরে আসে। এই সময় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাগুলোতে প্রাণচাঞ্চল্য বেড়ে যায়। অনেক ক্যাম্পাস এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে সেখানে নিজস্ব রেস্তোরাঁ, পার্ক, জাদুঘর, ঐতিহাসিক ভবন ও খোলা জায়গা রয়েছে। এসব স্থান সাধারণ মানুষের জন্যও উন্মুক্ত থাকে, যা পর্যটকদের জন্য বাড়তি সুবিধা তৈরি করে।
কলেজ ফুটবল ও ক্যাম্পাস সংস্কৃতি
যুক্তরাষ্ট্রে আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত কলেজ ফুটবলের মৌসুম চলে। এই সময় বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়ামগুলোতে উপচে পড়ে দর্শক। ফুটবল এখানে নিছক একটি খেলা নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব। খেলার আগেই শুরু হয় বড় আকারের জমায়েত, যেখানে শিক্ষার্থী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দারা একসঙ্গে খাবার, গান ও আড্ডায় মেতে ওঠেন।
মিডওয়েস্ট অঞ্চলের একটি বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম কলেজ ফুটবল স্টেডিয়ামে একসঙ্গে এক লক্ষের বেশি দর্শক বসতে পারেন। প্রাক্তন এক শিক্ষার্থীর ভাষায়, দলীয় সংগীত, মার্চিং ব্যান্ডের সুর আর হাজারো মানুষের একসঙ্গে উচ্ছ্বাস মিলিয়ে এটি এক ধরনের আবেগঘন অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। অন্য একটি রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর আয়োজন করা হয় বিশেষ এক ম্যাচ, যেখানে দর্শকেরা সাদা পোশাকে মাঠ ভরে তোলেন। আলো, সংগীত ও আতশবাজির সমন্বয়ে সেখানে তৈরি হয় এক ব্যতিক্রমধর্মী পরিবেশ।
আইভি লিগের ঐতিহ্য ও স্থাপত্য
উত্তর-পূর্ব যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ আটটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গঠিত আইভি লিগ শুধুই উচ্চমানের শিক্ষার জন্য পরিচিত নয়। ইতিহাস, স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকেও এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ক্যাম্পাসেই রয়েছে জাদুঘর, গ্রন্থাগার ও সবুজ প্রাঙ্গণ, যা দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।
দেশের প্রাচীনতম একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সপ্তদশ শতকে। সেখানে প্রাকৃতিক ইতিহাসের জাদুঘরে ফসিল, জীবাশ্ম ও নানা প্রাকৃতিক নিদর্শনের বিশাল সংগ্রহ দেখা যায়। কাছেই রয়েছে একটি বিস্তৃত আর্বোরেটাম, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গাছপালা সংরক্ষিত। আরেকটি ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস একসময় স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। সেখানে থাকা একটি ভবন অল্প সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অস্থায়ী রাজধানীর দায়িত্বও পালন করেছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা জাদুঘরে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক শিল্পকর্ম পর্যন্ত দেখা যায়। আরেকটি প্রতিষ্ঠানে গথিক স্থাপত্য, দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহশালা ও জাদুঘরের পাশাপাশি নিয়মিত নাটক, সংগীত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়, যা সাধারণ দর্শকের জন্য উন্মুক্ত।
ঐতিহাসিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার
যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর শিক্ষার সুযোগ তৈরি করতে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে প্রথম ঐতিহাসিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে দেশজুড়ে এমন শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
দক্ষিণের একটি বিখ্যাত পুরুষদের কলেজ বহু নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতার শিক্ষালয় হিসেবে পরিচিত। সেখানে একটি চ্যাপেলে রয়েছে বিশাল অর্গান ও ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন। প্রতিবছর মানবাধিকারভিত্তিক চলচ্চিত্র উৎসবও অনুষ্ঠিত হয়। আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক, যা এখন জাতীয় ঐতিহাসিক স্থানের মর্যাদা পেয়েছে। সেখানে বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদদের স্মরণে জাদুঘর ও সমাধিক্ষেত্র রয়েছে। রাজধানী শহরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর আয়োজিত হোমকামিং উৎসব পুরো সম্প্রদায়কে একত্র করে। শোভাযাত্রা, নাচ, সংগীত ও স্টেপ শো মিলিয়ে এটি একটি বড় সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপ নেয়।
ফুটবল মাঠের উচ্ছ্বাস, শতাব্দীপ্রাচীন ভবনের ছায়া কিংবা আফ্রিকান-আমেরিকান সংস্কৃতির প্রাণবন্ত প্রকাশ সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পর্যটকদের জন্য এক ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা এনে দেয়। প্রতিটি ক্যাম্পাস যেন নিজস্ব ইতিহাস ও গল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে শিক্ষার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বৈচিত্র্য ও সংস্কৃতির পরিচয় স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।



