আজ ২১ ডিসেম্বর। উত্তর গোলার্ধের মানুষের জন্য দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ আজই বছরের সবচেয়ে ছোট দিন এবং দীর্ঘতম রাত। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ঘটনাকে বলা হয় শীতকালীন অয়নকাল বা উইন্টার সোলস্টিস। এই দিনের মাধ্যমেই উত্তর গোলার্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক শীতের সূচনা ঘটে। সূর্য ও পৃথিবীর পারস্পরিক অবস্থানের কারণেই প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে এমন পরিবর্তন দেখা যায়।
পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর সামান্য হেলে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এই হেলনের কারণেই বছরের বিভিন্ন সময়ে দিন ও রাতের দৈর্ঘ্যে তারতম্য ঘটে। শীতকালীন অয়নকালের সময় পৃথিবীর উত্তর অংশ সূর্য থেকে সর্বাধিক দূরে হেলে থাকে। এর ফলে উত্তর গোলার্ধে সূর্যের কিরণ সবচেয়ে কম সময় ধরে পড়ে। আজকের দিনে তাই সূর্যোদয় দেরিতে হয় এবং সূর্যাস্ত ঘটে তুলনামূলকভাবে দ্রুত, যার ফলে রাত দীর্ঘতর হয়।
ওল্ড ফারমার্স অ্যালমানাকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সোলস্টিস কোনো একটি পুরো দিন নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তকে নির্দেশ করে। ওই মুহূর্তে কোনো একটি গোলার্ধ সূর্য থেকে সর্বোচ্চ দূরত্বে হেলে থাকে। যদিও বাস্তব জীবনে আমরা দিনটিকেই দীর্ঘতম রাত হিসেবে বিবেচনা করি, প্রকৃতপক্ষে এটি একটি সূক্ষ্ম জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা, যা সময়ের হিসাবে নির্ধারিত হয়।
উত্তর গোলার্ধ যখন আজ শীতের চরম অনুভূতি পাচ্ছে, তখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে একেবারে ভিন্ন চিত্র। দক্ষিণ গোলার্ধে বসবাসকারী মানুষ, যেমন অস্ট্রেলিয়া বা আর্জেন্টিনার নাগরিকরা আজ উদ্যাপন করছে গ্রীষ্মকালীন অয়নকাল। সেখানে আজ বছরের সবচেয়ে দীর্ঘ দিন এবং সবচেয়ে ছোট রাত। একই গ্রহে অবস্থান করেও সূর্যের সঙ্গে ভৌগোলিক অবস্থানের পার্থক্যের কারণে এমন বিপরীত অভিজ্ঞতা তৈরি হয়।
শীতকালীন অয়নকাল শুধু বৈজ্ঞানিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এর রয়েছে গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সভ্যতা এই দিনটিকে পরিবর্তন, পুনর্জন্ম ও আশার প্রতীক হিসেবে দেখেছে। দীর্ঘ অন্ধকারের পর ধীরে ধীরে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়তে শুরু করে, এই ধারণাই মানুষকে নতুন করে আলো ফিরে পাওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
প্যাগান বা প্রকৃতিপূজারী সম্প্রদায়ের কাছে এই দিন থেকে শুরু হয় ইউল উৎসব। দীর্ঘতম রাতের পর সূর্যের শক্তি আবার ধীরে ধীরে ফিরে আসছে, প্রকৃতি নতুন করে জেগে উঠবে, এই বিশ্বাস থেকেই ইউল পালনের রীতি গড়ে উঠেছে। আগুন জ্বালানো, সবুজ গাছপালা দিয়ে ঘর সাজানো এবং আলোকে কেন্দ্র করে নানা আচার এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। অনেক সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসে শীতকালীন অয়নকালকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।
ক্যালেন্ডারের হিসাবে, আজ ২১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক শীতকাল চলবে আগামী বছরের ২০ মার্চ পর্যন্ত। এই সময়জুড়ে উত্তর গোলার্ধে ঠান্ডার প্রকোপ বেশি থাকবে এবং দিনের দৈর্ঘ্য ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করবে। ২০ মার্চ বসন্তকালীন বিষুব বা স্প্রিং ইকুইনক্সের মাধ্যমে দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য প্রায় সমান হবে এবং এরপর শুরু হবে বসন্তকাল।
বছরের দীর্ঘতম রাত তাই শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, এটি সময়ের চক্র, পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা এবং নতুন শুরুর বার্তাও বহন করে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি পৃথিবীর কক্ষপথ ও অক্ষের হেলনের ফল, আর মানবসভ্যতার চোখে এটি আশার আলো ফিরে আসার এক প্রাচীন প্রতীক।



