ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য এবং কিয়েভের জন্য এটি এক অনিবার্য পরীক্ষার মুহূর্ত। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান বজায় রাখার প্রশ্নে এবার আর নৈতিকতা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ইউরোপীয় কাউন্সিলের সামনে থাকা সিদ্ধান্তটি নৈতিকভাবে সহজ মনে হলেও বাস্তব জগতের জটিলতায় তা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইউরোপীয় নেতাদের সামনে বিষয়টি প্রায় স্পষ্ট। রাশিয়া বেআইনিভাবে ও একতরফাভাবে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়েছে। মস্কো শান্তির কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না, বরং যুক্তরাজ্যসহ একাধিক দেশকে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ইউক্রেন ক্রমেই আর্থিক সংকটে পড়ছে। অথচ ইউরোপে, বিশেষ করে বেলজিয়ামে, প্রায় ১৮৪ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের রুশ সম্পদ এখনো জব্দ অবস্থায় রয়েছে। এই অর্থ ইউক্রেনকে সহায়তার কাজে ব্যবহার করা হলে তা অনেকের চোখে ইউরোপের নৈতিক দায়িত্ব পালনের প্রমাণ এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে আবারও শক্ত অবস্থান নেওয়ার বার্তা হতো।
কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এতটা সরল নয়। আইন, অর্থনীতি ও রাজনীতির জটিল হিসাব এই সিদ্ধান্তকে বিতর্কিত করে তুলেছে। সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়টি আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। অতীতে ক্ষতিপূরণ আরোপের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছে এমন উদাহরণও আছে। এই উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি রুশপন্থী শান্তি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এসব সম্পদ মুক্ত করার কথা ভাবছেন। দ্রুত একটি চুক্তি চেয়ে তিনি চাপ দিচ্ছেন এবং এ সপ্তাহান্তে মিয়ামিতে মার্কিন ও রুশ আলোচকরা আবার বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন।
এই জটিলতার মধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন একটি অর্থায়ন পরিকল্পনা দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছে, যেখানে রুশ সম্পদের মূল্য ব্যবহার করা হবে কিন্তু সরাসরি কিয়েভের হাতে তা তুলে দেওয়া হবে না। প্রস্তাবিত ঋণ কাঠামোটি সমর্থকদের মতে উদ্ভাবনী, আইনি এবং অত্যাবশ্যক। তবে মস্কো কিংবা ওয়াশিংটনের চোখে এটি কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না। শীর্ষ সম্মেলন শুরুর সময়ও কয়েকটি সদস্যরাষ্ট্র এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। বিশেষ করে বেলজিয়াম ছিল সবচেয়ে সংবেদনশীল অবস্থানে। কারণ এই পরিকল্পনার ঝুঁকি ভাগ করে নেওয়ার ফলে বন্ড বাজারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। একই সঙ্গে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে চাপে থাকা বহু ভোটার এত বড় আর্থিক সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হতে পারেন।
এ ধরনের পদক্ষেপ ভবিষ্যতে কী ধরনের নজির তৈরি করবে সেটিও বড় প্রশ্ন। বাস্তব সত্য হলো, এর প্রভাব অনেকটাই নির্ভর করবে যুদ্ধক্ষেত্র ও কূটনৈতিক অঙ্গনে কী ঘটে তার ওপর। এই সংঘাতের অবসান ঘটানোর মতো কোনো একক সমাধান নেই এবং রুশ সম্পদের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া ইইউ ঋণ পরিকল্পনাও যে যুদ্ধের মোড় পুরোপুরি ঘুরিয়ে দেবে এমন নিশ্চয়তা নেই। প্রায় চার বছর ধরে চলা নিষেধাজ্ঞাও রুশ অর্থনীতিকে প্রত্যাশিতভাবে দুর্বল করতে পারেনি। চীন ও ভারতের মতো দেশের কাছে তেল বিক্রির মাধ্যমে রাশিয়া এখনো বড় আকারে রাজস্ব আদায় করছে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও ইউরোপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদি এই ঋণ কার্যকর হয় কিন্তু ইউক্রেনের অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তাইওয়ানের মতো কোনো সংকটে ইউরোপের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে যেতে পারে। সংহতির এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের আরও কঠোর রূপ উন্মোচন করতে পারে। এখানে সহজ কোনো জয় নেই।
এই সব প্রশ্নই ব্যাখ্যা করে কেন চলতি সপ্তাহের ইউরোপীয় শীর্ষ সম্মেলন ইউক্রেনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে এটি ভিন্ন অর্থে হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যতের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই সম্মেলনের প্রথম পর্বে কোনো দ্রুত ঐকমত্য তৈরি হয়নি।
সব কিছুকে ছাপিয়ে একটি বাস্তবতা স্পষ্ট। রুশ সম্পদ কার্যকরভাবে ব্যবহার না করা হলে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষে আর বেশি দিন ধরে এই যুদ্ধের অর্থ জোগান দেওয়া সম্ভব হবে না, বিশেষ করে যুদ্ধ যদি শিগগিরই পঞ্চম বছরে পা রাখে। এই কারণেই এখনকার সিদ্ধান্তই হয়ে উঠেছে সত্যিকারের পরীক্ষার মুহূর্ত।



