Sunday, December 21, 2025
spot_img
Homeসম্পাদকীয়ইউরোপে সবুজ নীতিতে আবার ইউটার্ন

ইউরোপে সবুজ নীতিতে আবার ইউটার্ন

ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু নীতিতে নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে একসময় যে সিদ্ধান্তকে দেখা হয়েছিল, সেই সিদ্ধান্ত থেকেই সরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে ব্রাসেলস। ২০৩৫ সালের পর নতুন পেট্রোল ও ডিজেলচালিত গাড়ি বিক্রি নিষিদ্ধ করার যে পরিকল্পনা দুই বছর আগে গ্রহণ করা হয়েছিল, সেটিকে শিথিল করার প্রস্তাব দিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন। এই প্রস্তাব ভবিষ্যতের জন্য বড় ধরনের জটিলতা তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নীতিনির্ধারক ও বিশ্লেষকেরা।

দুই বছর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিনের যুগ থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়, তখন সেটিকে বৈশ্বিক নেতৃত্বের এক সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছিল। জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির মতো বড় গাড়ি উৎপাদনকারী দেশের সমন্বয়ে গঠিত এই জোট নতুন পেট্রোল ও ডিজেল গাড়ি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেট জিরো লক্ষ্য অর্জনের পথে দৃঢ় অবস্থানের বার্তা দিয়েছিল। এটি শুধু পরিবেশ রক্ষার প্রতিশ্রুতি নয়, বরং ভবিষ্যৎ শিল্পায়নের দিকনির্দেশনাও ছিল।

কিন্তু চলতি সপ্তাহে ব্রাসেলস থেকে আসা নতুন প্রস্তাব সেই বার্তাকে দুর্বল করে দিয়েছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, নির্দিষ্ট শর্তে ২০৩৫ সালের পরও কার্বন নিঃসরণকারী নতুন গাড়ি বাজারে আনার সুযোগ রাখা হতে পারে। জার্মানি ও ইতালির গাড়ি নির্মাতাদের দীর্ঘদিনের লবিংয়ের পর এই অবস্থান পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিল্প বিষয়ক কমিশনারের ভাষায়, এটি সংকটে থাকা ইউরোপীয় গাড়ি শিল্পের জন্য একটি স্বস্তির সুযোগ, যারা মার্কিন বাণিজ্যনীতি ও চীনের প্রতিযোগিতার চাপে বিপর্যস্ত।

তবে বাস্তবে এটি ইউরোপীয় নেতৃত্বের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতির প্রতিফলন বলেই মনে করছেন অনেকে। কমিশনের বর্তমান সভাপতির প্রথম মেয়াদে জলবায়ু কর্মসূচিকে ইউরোপের মূল অগ্রাধিকার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। তখন আধুনিকায়ন ও কার্বন নিঃসরণ হ্রাসকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে দেখা হতো, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। বর্তমানে অর্থনৈতিক চাপ, ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং নেট জিরো বিরোধী ডানপন্থী শক্তির উত্থান সেই অঙ্গীকারকে নড়বড়ে করে তুলেছে।

নীতিগত অসঙ্গতি ও দ্ব্যর্থপূর্ণ বার্তা দিয়ে কোনো বড় পরিবর্তন সফল করা যায় না। এই প্রস্তাবের সমালোচকেরা বলছেন, ইউরোপ যদি বৈশ্বিক গাড়ি শিল্পে নেতৃত্ব ধরে রাখতে চায়, তাহলে গতি কমানো নয় বরং রূপান্তর আরও দ্রুত করা প্রয়োজন। ২০৩৫ সালের সময়সীমা নিয়ে টানাপোড়েন নির্মাতাদের সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু এতে তারা পুরোনো প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে, যা দীর্ঘমেয়াদে শিল্পের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করবে।

ইতোমধ্যে ইউরোপ চীনের রাষ্ট্রীয় সহায়তাপ্রাপ্ত বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। চীনা কোম্পানিগুলো ইউরোপের বাজারে দ্রুত নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে, এমনকি উচ্চ শুল্ক আরোপের পরও। এই প্রেক্ষাপটে সময়সীমা শিথিল না করে বরং ভোক্তা চাহিদা বাড়াতে আর্থিক প্রণোদনা, চার্জিং অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ইউরোপীয় নির্মাতাদের জন্য সমান প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

আরও বিস্তৃতভাবে দেখলে, এমন এক সময়ে যখন যুক্তরাষ্ট্র পরিবেশগত দায়বদ্ধতা থেকে সরে আসছে এবং ইউরোপের ডানপন্থীরা নেট জিরো লক্ষ্যবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে, তখন একটি প্রতীকী সময়সীমা নিয়ে কারসাজি অশনি সংকেতের মতো। একসময় ইউরোপের সবুজ চুক্তিকে প্রবৃদ্ধির কৌশল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল, যা ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি দেবে। সেই বক্তব্য আজও প্রাসঙ্গিক, তবে তার জন্য প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পর্যাপ্ত সম্পদ ও সমন্বিত নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি।

সড়ক পরিবহন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের প্রায় এক-পঞ্চমাংশের জন্য দায়ী, যার বড় অংশ আসে ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে। নতুন দূষণকারী গাড়ি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত ২০৫০ সালের নেট জিরো লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা ছিল এবং ইউরোপকে সবুজ রূপান্তরের অগ্রভাগে নিয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক এই পিছু হটা পরিবেশের জন্য যেমন নেতিবাচক, তেমনি ইউরোপের গাড়ি শিল্পের ভবিষ্যতের জন্যও উদ্বেগজনক।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments