সূর্য থেকে উৎপন্ন একটি শক্তিশালী সৌরঝড় শিগগিরই পৃথিবীতে আঘাত হানতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে, এই সৌরঝড়ের প্রভাব শুধু মহাকাশেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এর সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে পৃথিবীর প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামোর ওপর। বিশেষ করে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর জন্য এটি হতে পারে বড় ধরনের হুমকি।
সৌরঝড় মূলত সূর্যের পৃষ্ঠে সৃষ্ট শক্তিশালী বিস্ফোরণের ফল। এসব বিস্ফোরণ থেকে বিপুল পরিমাণ শক্তি, বিকিরণ এবং চার্জিত কণা মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীদের ভাষায়, একে বলা হয় করোনাল মাস ইজেকশন বা ভূচুম্বকীয় ঝড়। এই কণাগুলো যখন পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটতে পারে।
বর্তমানে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে বিভিন্ন দেশের ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার স্যাটেলাইট সক্রিয় রয়েছে। ইন্টারনেট সংযোগ, টেলিযোগাযোগ, জিপিএস ব্যবস্থা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার বড় একটি অংশ এসব স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, শক্তিশালী সৌরঝড়ের ফলে এসব স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অচল হয়ে পড়তে পারে। নিয়ন্ত্রণ হারালে স্যাটেলাইটগুলো কক্ষপথে সঠিক অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে, যা ভয়াবহ সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি করবে।
বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সূর্য বর্তমানে তার সোলার ম্যাক্সিমাম পর্যায়ে রয়েছে। এই সময় সূর্যের কার্যকলাপ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় থাকে এবং সৌরঝড়ের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, যদি স্যাটেলাইট অপারেটররা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন, তবে মাত্র ২ দশমিক ৮ দিনের মধ্যেই কক্ষপথে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এমনকি নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যদি মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্যও বিচ্ছিন্ন থাকে, তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো কক্ষপথে ধারাবাহিক সংঘর্ষ শুরু হওয়া। বিশেষজ্ঞরা একে কেসলার সিনড্রোম হিসেবে উল্লেখ করেন। এই অবস্থায় একটি স্যাটেলাইট ধ্বংস হলে তার ধ্বংসাবশেষ আশপাশের অন্য স্যাটেলাইটের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটায়, ফলে ধ্বংসের পরিমাণ ক্রমেই বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে পুরো কক্ষপথ বিপুল পরিমাণ ধ্বংসাবশেষে ভরে যেতে পারে, যা দীর্ঘ সময়ের জন্য সেখানে নতুন স্যাটেলাইট স্থাপন বা পরিচালনাকে প্রায় অসম্ভব করে তুলবে।
এর প্রভাব পৃথিবীর দৈনন্দিন জীবনে মারাত্মকভাবে অনুভূত হতে পারে। জিপিএস ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়লে নৌযান, উড়োজাহাজ এবং স্থলভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থায় বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেবে। ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কে দীর্ঘস্থায়ী বিঘ্ন ঘটতে পারে, যা আর্থিক লেনদেন, জরুরি যোগাযোগ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে ব্যবহৃত স্যাটেলাইটগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পর্যবেক্ষণও বাধাগ্রস্ত হবে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সৌরঝড় পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও আগাম প্রস্তুতি ও সতর্কতার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কমানো যেতে পারে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় শক্তিশালী সৌরঝড় পৃথিবীর প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থার জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।



