কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্তার বিশ্বজুড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে। বিশেষ করে বড় আকারের এআই মডেল পরিচালনা এবং বিশাল তথ্যভান্ডার সচল রাখতে প্রয়োজন হচ্ছে বিপুল ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। এই চাহিদা মেটাতে যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আবারও কার্যক্রম শুরুর পথে। পেনসিলভানিয়ার থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর তথ্যভান্ডারের বিদ্যুৎ চাহিদার কারণে নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
১৯৭৯ সালে যান্ত্রিক ত্রুটি ও পরিচালনগত ভুলের কারণে থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। সে সময় কেন্দ্রটির ইউনিট ২ রিঅ্যাক্টরে আংশিক মেল্টডাউন বা পারমাণবিক গলনের ঘটনা ঘটে। যদিও ওই দুর্ঘটনায় কোনো প্রাণহানি হয়নি এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রমাণও পাওয়া যায়নি, তবুও নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক শক্তি ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে আছে।
দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আবার সচল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রে এআই তথ্যভান্ডারের দ্রুত বৃদ্ধি এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিদ্যুৎ চাহিদা। বিভিন্ন এআই সিস্টেম, বিশেষ করে বড় ভাষা মডেল ও ডেটা বিশ্লেষণভিত্তিক প্রযুক্তি, প্রচলিত ডিজিটাল সেবার তুলনায় অনেক বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। এসব সিস্টেমকে ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে নিরবচ্ছিন্ন শক্তির উৎস অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ু বা সৌরশক্তির মতো নবায়নযোগ্য উৎস গুরুত্বপূর্ণ হলেও শুধুমাত্র সেগুলোর ওপর নির্ভর করে বড় আকারের এআই তথ্যভান্ডারের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা কঠিন। আবহাওয়া নির্ভরতা ও উৎপাদনের ওঠানামার কারণে এসব উৎস সব সময় স্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে না। এই বাস্তবতায় পারমাণবিক শক্তিকে আবারও একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে থ্রি মাইল আইল্যান্ড কেন্দ্রের ইউনিট ১ রিঅ্যাক্টরকে নতুনভাবে চালু করা হচ্ছে। ১৯৭৯ সালের দুর্ঘটনার সময় এই রিঅ্যাক্টরটি সচল ছিল এবং পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় নিরাপদভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। তবে ২০১৯ সালে তুলনামূলকভাবে সস্তা প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে রিঅ্যাক্টরটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিবর্তিত বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতি এবং এআই প্রযুক্তির উত্থান সেই সিদ্ধান্তকে নতুনভাবে মূল্যায়নের সুযোগ এনে দিয়েছে।
এআই তথ্যভান্ডারের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে একটি বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে পারমাণবিক চুল্লি থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার নতুন মাত্রা পাচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, ভবিষ্যতের ডিজিটাল অবকাঠামো পরিচালনায় স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদি শক্তির উৎস হিসেবে পারমাণবিক বিদ্যুতের গুরুত্ব বাড়ছে।
নতুন প্রকল্পের আওতায় সরকারি ঋণ এবং বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে রিঅ্যাক্টরটির পুনর্গঠন ও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। পুনরায় চালু হওয়া এই কেন্দ্রটির নতুন নাম রাখা হয়েছে ক্রেন ক্লিন এনার্জি সেন্টার। পরিকল্পনা অনুযায়ী কেন্দ্রটি সচল হলে শত শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ নিকটবর্তী এআই তথ্যভান্ডারগুলোতে সরবরাহ করা হবে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির অব্যাহত বিকাশে সহায়ক হবে।
থ্রি মাইল আইল্যান্ডের পুনরুজ্জীবন কেবল একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার ঘটনা নয়। এটি একই সঙ্গে প্রযুক্তি, জ্বালানি নীতি এবং ভবিষ্যৎ ডিজিটাল অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকে তুলে ধরছে। অতীতের একটি বিতর্কিত পারমাণবিক স্থাপনা কীভাবে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজনে আবারও কার্যকর ভূমিকা নিতে যাচ্ছে, সেটিই এখন বিশ্বজুড়ে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।



