রাশিয়া ও ইউক্রেনের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ থামাতে নতুন করে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে ইউরোপের কেন্দ্রস্থল বার্লিনে। জার্মানির রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় দেশসমূহ ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। আলোচনার মূল লক্ষ্য ছিল ভবিষ্যতে সম্ভাব্য শান্তিচুক্তি হলে ইউক্রেনের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে এবং সে ক্ষেত্রে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের ভূমিকা নেবে। বৈঠক শেষে ইউক্রেনের জন্য একগুচ্ছ নিরাপত্তা নিশ্চয়তার খসড়া সামনে এসেছে, যা যুদ্ধ বন্ধের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বার্লিনের আলোচনায় ইউরোপীয় নেতারা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির পর ইউক্রেনকে একা ফেলে দেওয়া হবে না। ইউরোপের নেতৃত্বে একটি সমন্বিত বাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যার কাজ হবে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে সহায়তা করা এবং দেশটির আকাশ ও জলসীমা নিরাপদ রাখা। পাশাপাশি ভবিষ্যতে কোনো ধরনের হামলা হলে ইউক্রেনকে রক্ষায় আইনি প্রতিশ্রুতিও দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ইউরোপীয় নেতাদের মতে, এই আইনি অঙ্গীকার ইউক্রেনের নিরাপত্তাকে দীর্ঘমেয়াদে শক্ত ভিত্তি দেবে।
নিরাপত্তা নিশ্চয়তার তালিকায় ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের বিষয়ে সমর্থনের কথাও পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে দেশটির নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে সহায়তার অঙ্গীকার এসেছে ইউরোপের পক্ষ থেকে। প্রস্তাব অনুযায়ী, ইউক্রেনের সেনাসংখ্যা সর্বোচ্চ আট লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। যদিও রাশিয়া এর আগেই দাবি করে আসছে, শান্তিচুক্তির জন্য ইউক্রেনের সেনা এর চেয়ে অনেক কম হওয়া উচিত। এই বিষয়টি ভবিষ্যৎ আলোচনায় বড় একটি মতবিরোধের জায়গা হয়ে থাকতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রও ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রস্তাব দিয়েছে। ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে একটি যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, যা রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যেকোনো যুদ্ধবিরতি কার্যকরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। ভবিষ্যতে সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে আগাম সতর্কতা দেওয়ার ব্যবস্থাও এই কাঠামোর অংশ হবে। এ ছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের পুনর্গঠনে অর্থায়নের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, জব্দ করা রুশ সম্পদ থেকে পুনর্গঠনের অর্থ জোগাড় করা হতে পারে।
এর আগেও ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র শান্তিচুক্তির লক্ষ্যে ইউক্রেনের সঙ্গে একাধিক দফা আলোচনা করেছে। তবে বার্লিনের বৈঠকে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর অবস্থান তুলনামূলকভাবে আরও দৃঢ় ছিল। এই বৈঠকে কিয়েভের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ভবিষ্যতে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। যদিও বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়, তবুও এটি ইউক্রেনের জন্য বড় ধরনের কৌশলগত সুবিধা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই নিরাপত্তা নিশ্চয়তার তালিকায় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানিসহ ইউরোপের আরও সাতটি দেশের নেতারা সই করেছেন। তাঁদের ভাষ্য, যুদ্ধ বন্ধে সম্মত হলে ইউক্রেনকে ব্যাপক নিরাপত্তা সহায়তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারেও সাহায্য দেওয়া হবে। জার্মান সরকারের প্রধানের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি বাস্তব শান্তি প্রক্রিয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং সেটিকে কাজে লাগানো জরুরি।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, এই উদ্যোগ কি দ্রুত যুদ্ধ থামাতে পারবে। এখনো তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ, আলোচনার নেতৃত্বে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এই নিরাপত্তা নিশ্চয়তার তালিকা রাশিয়ার কাছে উপস্থাপন করবেন। ক্রেমলিন এই প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। রাশিয়া বরাবরই ইউক্রেনের ভূখণ্ডে ন্যাটোর সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করে আসছে। পাশাপাশি ইউক্রেনের দখলকৃত অঞ্চলগুলো নিয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো এখনো সম্ভব হয়নি।
মার্কিন মধ্যস্থতাকারীদের দাবি, শান্তিচুক্তির কাঠামোর বড় একটি অংশ ইতোমধ্যে প্রস্তুত। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে সামনে এখনও অনিশ্চয়তাই বেশি। বার্লিনের বৈঠক ইউক্রেনের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি এনে দিলেও, সেগুলো বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক অগ্রগতি এবং রাশিয়ার প্রতিক্রিয়ার ওপর।



