দীর্ঘদিন ধরেই বেলারুশে বড় পরিসরের রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। তবে বিষয়টি নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বা নির্দিষ্ট তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট মহলের নীরবতার পেছনে ছিল একটাই কারণ, মুক্তির প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে ঝুঁকিতে ফেলতে না চাওয়া। শেষ পর্যন্ত সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে মোট ১২৩ জন রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি পান। তাঁদের মধ্যে সরকারবিরোধী রাজনীতিক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের মতো পরিচিত মুখও রয়েছেন।
মুক্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় ছিলেন আলোচিত এক প্রতিবাদী নেতা, যিনি লাল লিপস্টিক আর হাস্যোজ্জ্বল মুখের জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিত। কারাগার থেকে বেরিয়ে অন্য সাবেক বন্দীদের সঙ্গে তাঁর আবেগঘন আলিঙ্গনের দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে বেলারুশ ত্যাগের সময় বাসের ভেতর ধারণ করা এক ভিডিও বার্তায় তিনি এই মুহূর্ত সম্ভব করে তোলায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, প্রিয়জনদের আবার দেখতে পাওয়া এবং সবাই একসঙ্গে মুক্ত এই উপলব্ধি তাঁর কাছে ভাষায় প্রকাশের বাইরে এক অনুভূতি। মুক্তির পর প্রথম সূর্যাস্তের কথা উল্লেখ করে তিনি সেটিকে জীবনের এক অসাধারণ মুহূর্ত হিসেবে বর্ণনা করেন। একই সঙ্গে তিনি স্মরণ করেন সেই সব বন্দীর কথা, যাঁরা এখনো কারাগারে আছেন এবং সবার মুক্তির আশায় অপেক্ষার কথা জানান।
এই দফায় মুক্তি পান একজন সাবেক ব্যাংকারও, যিনি ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়েছিলেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর আগেই তাঁকে আটক করা হয় এবং দীর্ঘদিন কারাভোগ করতে হয়। একই সঙ্গে মুক্তি পেয়েছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত এক মানবাধিকারকর্মী, যিনি এক দশকের সাজা ভোগ করছিলেন।
এই সব বন্দীই দীর্ঘদিন ধরে বেলারুশের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরোধিতা করে আসছিলেন। ২০২০ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর দেশজুড়ে যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তা কঠোরভাবে দমন করা হয়। সেই আন্দোলনই ছিল বর্তমান শাসকের ক্ষমতার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
দীর্ঘ ও জটিল দর কষাকষির পর এই মুক্তির পথ তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে হওয়া আলোচনার ফলেই বন্দীরা কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের নতুন বিশেষ দূতের দুই দিনের মিনস্ক সফরের সময় বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
এই সমঝোতা শাসকগোষ্ঠীর জন্য এক ধরনের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবেই দেখা হচ্ছে। দীর্ঘদিন পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল থাকার পর আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় ফিরতে পেরে বেলারুশের নেতৃত্ব সন্তুষ্ট বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি দেশটির গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য পটাশের ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টিও বড় অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল রয়েছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগের পেছনের উদ্দেশ্য পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বেলারুশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এমন এক সময়ে এই বন্দীমুক্তি হয়েছে, যখন ওয়াশিংটন শান্তিচুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে মস্কোর সঙ্গে আবার যোগাযোগ বাড়াচ্ছে।
মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীদের একটি অংশকে লিথুয়ানিয়ার রাজধানীতে নেওয়া হয়। সেখানে তীব্র শীতের মধ্যেও মার্কিন দূতাবাসের সামনে জড়ো হন স্বজন ও সহকর্মীরা। অনেকের গায়ে ছিল বিরোধী আন্দোলনের লাল সাদা পতাকা। দীর্ঘদিন আন্দোলনের পর প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ ছিল চোখে পড়ার মতো।
তবে সবাইকে একসঙ্গে পরিবারের কাছে ফিরতে দেওয়া হয়নি। কয়েকজনকে বেলারুশ থেকে ইউক্রেনে পাঠানো হয়, যা বিরোধী মহলে নতুন করে প্রশ্ন ও ক্ষোভ তৈরি করেছে। বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি মন্তব্য করেন, এটি শাসকের শেষ মুহূর্তের কৌশল, যাতে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতেই থাকে।
এই মুক্তির বিনিময়ে কী মূল্য দিতে হলো, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বিরোধী নেতৃত্বের এক মুখ্য প্রতিনিধি বলেন, এটি দর কষাকষির অংশ। প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আবার আরোপ করা যেতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, বর্তমান মার্কিন প্রশাসন প্রণোদনা ও চাপ দুই পথই খোলা রাখছে।
মুক্তিপ্রাপ্ত নোবেলজয়ী মানবাধিকারকর্মী দূতাবাসের বাইরে এলে জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। দীর্ঘ কারাভোগের পর শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও তিনি জানান, এত আবেগ একসঙ্গে আসায় নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, তাঁর মতো আরও বহু অচেনা মানুষ এখনো কারাগারে বন্দী আছেন এবং তাঁদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াই সবচেয়ে জরুরি।
শেষে তিনি বিশ্বজুড়ে থাকা বেলারুশের নাগরিকদের উদ্দেশে একটি বার্তা দেন। তাঁর কণ্ঠে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়, আশাবাদ আর প্রতিবাদের পথ কখনোই ছেড়ে দেওয়া যাবে না।



