বিশ্ববাজারে রুপার দাম নজিরবিহীন উচ্চতায় পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই মূল্যবান এই ধাতু স্পট মার্কেটে রেকর্ড গড়েছে। একই সঙ্গে বিনিয়োগের পাশাপাশি প্রযুক্তি ও শিল্পখাতে রুপার ব্যবহার বাড়তে থাকায় ভবিষ্যতেও এর চাহিদা আরও বিস্তৃত হওয়ার ইঙ্গিত মিলছে।
গত ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে রুপার দাম প্রথমবারের মতো আউন্সপ্রতি ৬০ ডলারে পৌঁছায়। স্পট মার্কেট মূলত সেই বাজার, যেখানে মূল্যবান ধাতু তাৎক্ষণিক লেনদেনের মাধ্যমে কেনাবেচা করা হয়। এই মূল্যবৃদ্ধিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
চলতি সপ্তাহে সোনার দামও ঊর্ধ্বমুখী ছিল। বছরের শুরুতেই সোনার মূল্য রেকর্ড পর্যায়ে উঠেছিল, যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা বড় ভূমিকা রেখেছে। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এসব অনিশ্চয়তার সময়ে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিমুক্ত বা নিরাপদ হিসেবে পরিচিত ধাতুর দিকে ঝুঁকে পড়েন।
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি সুপরিচিত প্রবণতা হলো, যখন সুদহার কমে এবং মার্কিন ডলারের মান দুর্বল হয়, তখন তারা সোনা ও রুপার মতো মূল্যবান ধাতুতে বিনিয়োগ বাড়ান। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের প্রধান সুদহার দশমিক ২৫ শতাংশ কমানোর ঘোষণা দেয়। এর ফলে ব্যাংকে আমানত বা স্বল্পমেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগের আকর্ষণ কমে যায়।
এ বিষয়ে সিঙ্গাপুরের একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক জানান, সুদহার কমার সময় ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা সাধারণত রুপার মতো বাস্তব সম্পদ কিনে রাখতে আগ্রহী হন। কারণ, তখন নগদ অর্থ রাখলে প্রত্যাশিত মুনাফা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। রুপা ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতুকে তাই দীর্ঘদিন ধরেই নিরাপদ সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিগত কয়েক মাসে সোনার দাম আউন্সপ্রতি চার হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়, যা ইতিহাসে প্রথম। একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকের বাজার বিশ্লেষকের মতে, সোনার এই লাগাতার মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব রুপার বাজারেও পড়েছে। তুলনামূলক কম দামে বিনিয়োগের সুযোগ থাকায় অনেক বিনিয়োগকারী রুপার দিকে ঝুঁকছেন।
চলতি বছরে সোনার দাম প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাপক হারে সোনা কেনায় এই মূল্যবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়েছে। একই সময়ে প্ল্যাটিনাম ও প্যালাডিয়ামের দামও ঊর্ধ্বমুখী ছিল, যা সামগ্রিকভাবে মূল্যবান ধাতুর বাজারকে চাঙ্গা করেছে।
সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি
রুপার দাম বাড়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো শিল্পখাতে এর ক্রমবর্ধমান ব্যবহার। সিঙ্গাপুরের একটি ব্যবস্থাপনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, রুপা এখন আর কেবল বিনিয়োগের ধাতু নয়, বরং আধুনিক শিল্পের একটি অপরিহার্য উপাদান। বিদ্যুৎ পরিবাহিতার ক্ষেত্রে রুপা সোনা ও তামার চেয়েও বেশি কার্যকর।
এই বৈশিষ্ট্যের কারণে বৈদ্যুতিক গাড়ি ও সৌর প্যানেল উৎপাদনে রুপার ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। এর ফলে ব্যাটারি ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ তৈরিতে রুপার প্রয়োজন আরও বাড়বে।
তবে সমস্যা হলো, রুপার সরবরাহ দ্রুত বাড়ানো সহজ নয়। সাধারণত যেসব খনি থেকে সিসা, তামা ও সোনা উত্তোলন করা হয়, সেখান থেকেই উপজাত হিসেবে রুপা পাওয়া যায়। ফলে চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ সমানতালে বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতির অংশ হিসেবে রুপার ওপর শুল্ক আরোপের আশঙ্কাও বাজারে প্রভাব ফেলছে। শুল্কের সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রে আগেভাগেই রুপা মজুত করা হচ্ছে। এর ফলে বিশ্ববাজারে সরবরাহ কমে গিয়ে দাম আরও চড়ছে। বর্তমানে বিশ্বের মোট রুপার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করে থাকে, যা শিল্প, অলংকার ও বিনিয়োগ খাতে ব্যবহৃত হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, শিল্পখাতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান রুপার সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এই প্রতিযোগিতার প্রভাব সরাসরি দামে পড়ছে। তাঁদের ধারণা, আগামী কয়েক মাসেও রুপার দাম উচ্চ পর্যায়েই থাকতে পারে।



