Monday, December 22, 2025
spot_img
Homeকমিউনিটি সংবাদশামিমা বেগম প্রসঙ্গ ঘিরে নাগরিকত্ব শঙ্কা

শামিমা বেগম প্রসঙ্গ ঘিরে নাগরিকত্ব শঙ্কা

যুক্তরাজ্যে নাগরিকত্ব বাতিলের একটি কঠোর ও গোপন ক্ষমতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকা এই ক্ষমতার কারণে বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, ভারতীয় বংশোদ্ভূতসহ প্রায় ৯০ লাখ মানুষ আইনগতভাবে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে থাকতে পারেন। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে, যা যুক্তরাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর শঙ্কা তৈরি করেছে।

এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের দুটি প্রভাবশালী মানবাধিকার ও নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষ এমন অবস্থানে আছেন, যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে তাঁদের নাগরিকত্ব বাতিল করা সম্ভব। বিষয়টি আইনের আওতায় থাকলেও এর প্রয়োগ পদ্ধতি এবং স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন অধিকারকর্মীরা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, নাগরিকত্ব বাতিলের এই ক্ষমতা দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে পারিবারিক বা বংশগত সম্পর্ক রয়েছে এমন নাগরিকদের ওপর অসমভাবে প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠী এই ব্যবস্থার কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অধিকার সংগঠনগুলোর ভাষায়, এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি পদ্ধতিগত হুমকিতে রূপ নিচ্ছে। অনেকের মতে, এই পরিস্থিতি অতীতে ক্যারিবীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারির সঙ্গে তুলনীয়।

বর্তমান আইনের অধীনে, কোনো ব্রিটিশ নাগরিক যদি অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হন, তাহলে তাঁর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করা যেতে পারে। তিনি ওই দেশে কখনো বসবাস না করলেও বা নিজেকে সে দেশের নাগরিক মনে না করলেও এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই বিধানই মূলত বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে।

গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এসব অঞ্চলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এর ফলে নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে একটি বর্ণভিত্তিক স্তরবিন্যাস তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন অধিকারকর্মীরা। তাঁদের মতে, এতে মুসলিম নাগরিকদের যুক্তরাজ্যে থাকার অধিকার শর্তসাপেক্ষ হয়ে পড়ছে, যা শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায় না।

একটি মানবাধিকার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, রাজনৈতিক সুবিধার জন্য আগের সরকার মানব পাচারের শিকার কিছু ব্রিটিশ নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল। বর্তমান সরকার সেই ক্ষমতা আরও সম্প্রসারিত করেছে, যা ভবিষ্যতে বড় ধরনের অপব্যবহারের পথ খুলে দিতে পারে। বিশেষ করে কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় এলে এই ক্ষমতা ৯০ লাখ মানুষের অধিকার হরণে ব্যবহৃত হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

অন্যদিকে, একটি নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বলেন, নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপক কর্তৃত্ব মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অসমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাঁর ভাষায়, উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারির সময়কার মতোই এখানে কার্যকর নজরদারি ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। ফলে এই ক্ষমতার অপব্যবহার ঠেকানোর মতো শক্ত কোনো কাঠামো দেখা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, নাগরিকত্ব কোনো সুযোগ নয়, এটি একটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু একের পর এক সরকার নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে দ্বিস্তরের নীতি চালু করে বিপজ্জনক একটি নজির স্থাপন করছে।

প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান আরও উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর পাঁচজনের মধ্যে তিনজন নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিপরীতে, শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি মাত্র ২০ জনে ১ জন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রায় ৯ লাখ ৮৪ হাজার, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ৬ লাখ ৭৯ হাজার এবং বাংলাদেশিসহ মোট ৩৩ লাখ এশীয় ব্রিটিশ এই ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে পড়েন। বাস্তবে যাঁদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই দক্ষিণ এশীয়, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বংশোদ্ভূত মুসলিম।

নাগরিকত্ব বাতিলের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি হলো শামিমা বেগমের মামলা। যুক্তরাজ্যে জন্ম নেওয়া এই তরুণীর নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল এই যুক্তিতে যে তিনি নাকি বাংলাদেশের নাগরিক। যদিও বাংলাদেশ সরকার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। কিশোর বয়সে তিনি যুক্তরাজ্য ছেড়ে আইএসে যোগ দিয়েছিলেন এবং পরে দেশে ফেরার চেষ্টা করলে তাঁর আবেদন নাকচ করা হয়।

এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। এর মধ্যেই কনজারভেটিভ ও রিফর্ম ইউকে দলের কয়েকজন রাজনীতিক আরও কঠোর অবস্থানের কথা বলছেন। তাঁদের বক্তব্যে এমন পরিকল্পনার ইঙ্গিত মিলছে, যার মাধ্যমে আইনিভাবে বসবাসকারী লাখো মানুষকে যুক্তরাজ্য ছাড়তে বাধ্য করা হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে নাগরিকত্ব ও সমান অধিকারের প্রশ্নটি নতুন করে তীব্র আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments