যুক্তরাষ্ট্রের একটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষার সময় হঠাৎ ফোনে ভেসে আসে জরুরি সতর্কবার্তা। ক্যাম্পাসে সম্ভাব্য বন্দুক হামলার আশঙ্কা জানিয়ে সবাইকে নিরাপদ স্থানে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই সতর্কবার্তা এক শিক্ষার্থীর কাছে ছিল ভয়াবহ স্মৃতির পুনরাবৃত্তি। কারণ, তিনি এর আগেও নিজের শিক্ষাজীবনে একটি গণগুলিবর্ষণের শিকার হয়েছেন।
ওই শিক্ষার্থী বর্তমানে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। সতর্কবার্তা পাওয়ার মুহূর্তে তিনি নিজের ডরমিটরিতে এক বন্ধুর সঙ্গে পড়াশোনা করছিলেন। প্রথম বার্তায় জানানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকৌশল ভবনে জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শুরুতে তিনি ভাবতে চেয়েছিলেন, বিষয়টি হয়তো অন্য কিছু। কিন্তু পরপর বার্তায় যখন জানালা থেকে দূরে থাকা, দরজা বন্ধ করে নিরাপদে থাকার নির্দেশ আসে, তখন ব্যবহৃত ভাষাই তাকে বাস্তবতা বুঝিয়ে দেয়।
২০১৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি উচ্চবিদ্যালয়ে ভয়াবহ গণগুলিবর্ষণে তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। ওই ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হন এবং তিনি সহ আরও দুজন গুলিবিদ্ধ হন। দীর্ঘ চিকিৎসা ও মানসিক ধাক্কা সামলে তিনি আবার পড়াশোনায় ফিরে আসেন। কিন্তু শনিবারের এই সতর্কতা যেন সেই পুরোনো ক্ষত আবার খুলে দেয়।
দিন শেষে নিশ্চিত হয়, রোড আইল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের প্রভিডেন্স শহরে ঘটে যাওয়া ওই হামলায় দুইজন নিহত এবং নয়জন আহত হয়েছেন। আবারও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রক্তাক্ত হলো।
এক সাক্ষাৎকারে ওই শিক্ষার্থী বলেন, একজন মানুষের জন্য একবারের বন্দুক হামলাই যথেষ্ট ভয়াবহ। অথচ তাঁকে জীবনে দ্বিতীয়বার একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো। কিশোর বয়সে যে অভিজ্ঞতা তিনি পেছনে ফেলে এসেছিলেন, তা আবার ফিরে আসবে, এমনটা তিনি কল্পনাও করেননি।
এই ঘটনা আজকের প্রজন্মের অনেক শিক্ষার্থীর বাস্তবতাকে তুলে ধরে। যারা ছোটবেলা থেকেই লকডাউন ড্রিল, অ্যাকটিভ শুটার মহড়ার মধ্যে বড় হয়েছে, তারা কলেজে গিয়েও সেই একই সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যারা জীবনের ভিন্ন ভিন্ন ধাপে একাধিক গণগুলিবর্ষণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি জানান, ফ্লোরিডার পার্কল্যান্ডের কুখ্যাত স্কুল হামলার সময় তিনি পাশের একটি মধ্যবিদ্যালয়ে পড়তেন। ঘটনার সময় তিনি বাইরে ছিলেন এবং গুলির শব্দ, মানুষের চিৎকার শুনেছেন। পরে উদ্ধারকর্মীদের তৎপরতা দেখেছেন এবং ভিডিওতে সেই ভয়াবহ দৃশ্য আবার দেখেছেন।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে বসবাসকারী এক শিক্ষার্থী শনিবারের ঘটনায় চরম আতঙ্কে রাত কাটান। তাঁর বাসা ঠিক সেই ভবনের সামনেই, যেখানে হামলার ঘটনা ঘটে। তিনি ও তাঁর রুমমেটরা আশঙ্কা করছিলেন, হামলাকারী হয়তো তাঁদের বাসায় লুকিয়ে থাকতে পারে। তারা দরজার সামনে ফ্রিজ ও বুককেস দিয়ে অস্থায়ী ব্যারিকেড তৈরি করেন এবং বোতল রেখে দেন, যাতে কেউ ঢোকার চেষ্টা করলে শব্দ হয়। সারা রাত তিনি পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তাঁর কণ্ঠে আতঙ্ক স্পষ্ট ছিল।
এই শিক্ষার্থীর পরিবার আগেও সহিংসতার শিকার হয়েছে। কয়েক বছর আগে তাঁর বাবা হত্যাচেষ্টা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যান। সেই ঘটনার পর পরিবারটির জীবনে স্থায়ী পরিবর্তন আসে। পরিবারের মতে, সাম্প্রতিক এই ক্যাম্পাস হামলাও তাদের ওপর একই রকম মানসিক প্রভাব ফেলবে।
ওই শিক্ষার্থীর বাবা, যিনি একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, বলেন বন্দুক সহিংসতার প্রভাব শুধু আহত বা নিহতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এর প্রভাব পড়ে পরিবার, বন্ধু এবং পুরো সমাজের ওপর। এসব ক্ষত দৃশ্যমান না হলেও গভীরভাবে মানসিক আঘাত সৃষ্টি করে। তাঁর আশা, একদিন দেশ হিসেবে সবাই মিলে অর্থবহ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
উচ্চবিদ্যালয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওই ব্রাউন শিক্ষার্থী অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইনের দাবিতে সক্রিয় হন। তিনি শিক্ষার্থীদের একটি আন্দোলনমূলক সংগঠনের নেতৃত্বে যুক্ত হন এবং এ বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে কাজ করেন। তাঁর এই কর্মকাণ্ড তাঁকে হোয়াইট হাউস পর্যন্ত নিয়ে যায় এবং তৎকালীন শীর্ষ আইন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ তৈরি করে।
বিশেষভাবে তিনি নজর দিয়েছেন তথাকথিত ঘোস্ট গান বিষয়ে, যেগুলো আলাদা অংশ দিয়ে তৈরি করা যায় এবং যার মালিকানা শনাক্ত করা কঠিন। তাঁর মতে, এসব অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি এমন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন নিয়ে গবেষণাপত্র লিখছিলেন, যারা স্কুলে গুলিবর্ষণের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। কাকতালীয়ভাবে, সেই গবেষণাপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা ছিল কয়েক দিনের মধ্যেই।
তিনি বলেন, ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে এটিই প্রথম সক্রিয় শুটার সতর্কবার্তা, যা তিনি পেয়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি বেছে নিয়েছিলেন নিরাপদ একটি জায়গা ভেবে, যেখানে তিনি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন। কিন্তু আবারও সেই নিরাপত্তাবোধ ভেঙে পড়েছে।
এই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্দুক সহিংসতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে এবং একটি প্রজন্মের মানসিক বাস্তবতাকে সামনে এনেছে।



