অস্ট্রেলিয়ার বন্ডি বিচে সংঘটিত ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা বিশ্বজুড়ে গভীর শোক ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। পারিবারিক আনন্দ ও উৎসবের পরিবেশে পরিপূর্ণ একটি সমুদ্রসৈকতে এমন নৃশংস সহিংসতা শুধু অস্ট্রেলিয়াই নয়, গোটা মানবসমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে। অন্তত ১৬ জন নিহত এবং ২৯ জন গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় দেশটির ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র ভয় ও মানসিক আঘাত তৈরি হয়েছে। আনন্দের প্রতীক হানুকা উৎসবের সূচনালগ্নে এই হামলা হওয়ায় শোকের মাত্রা আরও গভীর হয়েছে।
নিরাপত্তা সংস্থাগুলো দ্রুত ঘটনাটিকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সৈকতে হানুকা উদযাপনের জন্য জড়ো হওয়া ইহুদিদের লক্ষ্য করেই এই আক্রমণ চালানো হয় বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। একটি সেতু থেকে গুলি চালানো হয় জনসমাবেশের ওপর। শিশুদের কোলে নিয়ে ছুটে পালাতে দেখা যায় অভিভাবকদের, আর বয়স্ক মানুষদের জন্য নিরাপদে সরে যাওয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন। হামলাকারীদের একজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয় এবং আরেকজন গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি থাকে। আশপাশে বিস্ফোরক সদৃশ ডিভাইসভর্তি একটি গাড়িও উদ্ধার করা হয়। রোববার রাত পর্যন্ত সম্ভাব্য আরেক হামলাকারীর খোঁজে তল্লাশি চালায় পুলিশ।
এই ভয়াবহতার মাঝেও কয়েকজন সাধারণ মানুষের সাহসিকতা আরও বড় বিপর্যয় ঠেকাতে ভূমিকা রাখে। একজন ব্যক্তি একাই একজন হামলাকারীর কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেন এবং অন্যদের দ্রুত প্রতিক্রিয়ায় হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারেনি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই হামলা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে ইহুদিবিদ্বেষী হামলা ও সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল আক্রমণ এবং পরবর্তী গাজা যুদ্ধের পর থেকে এই প্রবণতা আরও তীব্র হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বন্ডি বিচের হামলা বৈশ্বিক বাস্তবতারই একটি ভয়ংকর প্রতিফলন। কোনো রাজনৈতিক বা আদর্শিক অবস্থানই এমন নৃশংস সহিংসতার ন্যায্যতা দিতে পারে না।
অস্ট্রেলিয়ায় এর আগেও সিনাগগ ও অন্যান্য স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মতে, এর কিছু ঘটনার পেছনে বিদেশি শক্তির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও রয়েছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইহুদিদের লক্ষ্য করে সহিংস হামলা বেড়েছে। বিভিন্ন আদর্শ ও চরমপন্থা থেকে এই হুমকি আসছে বলে সতর্ক করেছেন সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞরা।
অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সন্ত্রাসী হামলার ভয়াবহ উদাহরণ রয়েছে। ২০০২ সালে বালিতে বোমা হামলায় বহু অস্ট্রেলীয় নাগরিক নিহত হন। ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলাও এই অঞ্চলের নিরাপত্তা বাস্তবতা তুলে ধরে। তবুও বন্ডি বিচের এই ঘটনা দেশটির মাটিতে সংঘটিত সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ১৯৯৬ সালের পোর্ট আর্থার গণহত্যার পর এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ গুলিবর্ষণের ঘটনা। সেই ঘটনার পরই অস্ট্রেলিয়া কঠোর অস্ত্র আইন প্রণয়ন করেছিল। বর্তমানে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের নতুন করে উদ্বেগের বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখার দাবি উঠেছে।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, এই অন্ধকার সময়ে একে অন্যের জন্য আলোর উৎস হতে হবে। তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট করা হয়, ইহুদি অস্ট্রেলীয়দের ওপর আক্রমণ মানে পুরো অস্ট্রেলীয় সমাজের ওপর আঘাত। হামলাকারীরা নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করলেও তাদের সহিংসতা সমাজের সামগ্রিক বন্ধনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে যারা বিভাজন উসকে দিতে চাইবে, তাদেরও প্রতিরোধ করতে হবে।
বিশ্বের নানা সংস্কৃতিতে বছরের অন্ধকার সময়ে আলো জ্বালানোর রীতি রয়েছে। এসব আচার আলাদা ইতিহাস ও অর্থ বহন করলেও একটি বিষয় সবার মধ্যে, অন্ধকারের মধ্যেও আলো টিকে থাকার বার্তা। আলো নিভে যাওয়ার আশঙ্কা যত বেশি, একে রক্ষা ও লালন করার দায়িত্ব তত বেশি সবার ওপর বর্তায়। বন্ডি বিচের ট্র্যাজেডি সেই দায়িত্বের কথাই নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছে।



