ক্রিসমাসের মূল বার্তা মানবিকতা, সহমর্মিতা ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান বহন করে। খ্রিস্টীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, মানবজাতির ত্রাণকর্তার জন্ম হয়েছিল চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। বেথলেহেমে থাকার জায়গা না পেয়ে একটি গোয়ালঘরে আশ্রয় নিতে হয়েছিল মা ও শিশুকে। জন্মের পরপরই রাজা হেরোদের হত্যার হুমকি থেকে বাঁচতে পরিবারটি পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় মিসরে। এই গল্প শুধু ধর্মীয় আখ্যান নয়, এটি অপরিচিত, শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রতি সহানুভূতির এক শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে। বাইবেলের নতুন নিয়মে যিশুর বাণী স্পষ্টভাবে এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলে, যেখানে ক্ষুধার্তকে খাবার দেওয়া এবং অপরিচিতকে আশ্রয় দেওয়াকে বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখা হয়েছে।
কিন্তু ব্রিটেনে সাম্প্রতিক সময়ে যে ধরনের চরম ডানপন্থী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে এই শিক্ষার সুস্পষ্ট সংঘাত তৈরি হয়েছে। কারাবাসের সময় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের দাবি করা এক কট্টর ডানপন্থী কর্মী এখন ধর্মীয় পরিচয়কে ব্যবহার করছেন জাতিগত বিভাজন ও রাজনৈতিক মেরুকরণ উসকে দিতে। তাঁর উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন সমাবেশে ধর্মীয় সংগীত, কাঠের ক্রস এবং এমন ভাষণ শোনা গেছে যেখানে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের আহ্বান প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে আয়োজন করা একটি ক্যারল অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা যায়, যা বাহ্যত ক্রিসমাস উদযাপনের নামে হলেও প্রকৃতপক্ষে শান্তি ও সৌহার্দ্যের ধারণার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে।
এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে শুধু হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেওয়া সহজ হলেও বাস্তবতা হলো, ব্রিটেনে খ্রিস্টীয় জাতীয়তাবাদের উত্থানকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন। অতীতে প্রান্তিক চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোতে ধর্মীয় যুদ্ধের ভাষা শোনা গেলেও, বর্তমানে তা আরও বিস্তৃত জনপরিসরে ছড়িয়ে পড়ছে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে সাংস্কৃতিক খ্রিস্টধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতাও স্পষ্ট হচ্ছে। কিছু রাজনৈতিক দলের ভেতরে দেখা যাচ্ছে, ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে রেখে অভিবাসনবিরোধী ও বহিষ্কারমূলক নীতিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা।
এই ধরনের জাতিকেন্দ্রিক রাজনীতি, যা বিদেশি বিদ্বেষ, সাংস্কৃতিক একচেটিয়াতা এবং নির্বিচার বিতাড়নকে স্বাভাবিক করে তোলে, তা খ্রিস্টীয় শিক্ষার সঙ্গে মৌলিকভাবে সাংঘর্ষিক। খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে বারবার এই বিষয়টি উচ্চারিত হয়েছে যে মানুষকে তার জাতি, ভাষা বা সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে বিভক্ত করা বিশ্বাসের মূল সত্তার পরিপন্থীা। ব্রিটেনের চার্চ অব ইংল্যান্ডও সম্প্রতি চরম ডানপন্থীদের হাতে ধর্মীয় প্রতীক ও বাণীর অপব্যবহারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। চার্চের একজন বিশপ স্পষ্টভাবে বলেছেন, ধর্মান্তর কাউকে নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিশ্বাসকে বিকৃত করার অধিকার দেয় না।
সমসাময়িক চরম ডানপন্থী আন্দোলন বিভিন্ন রূপে খ্রিস্টধর্মকে সাংস্কৃতিক ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের বাহন হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছে। এতে মানুষের অর্থবোধ ও পরিচয়ের আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগিয়ে একটি বিভাজনমূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। বিশ্বের অন্য দেশেও এই প্রবণতার নজির রয়েছে, যেখানে ধর্মীয় ভাষা ব্যবহার করে কর্তৃত্ববাদী ও বর্জনমূলক নীতিকে নৈতিক মোড়ক দেওয়া হয়েছে।
খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থে প্রেরিত পলের বাণীতে বলা হয়েছে, বিশ্বাসের ভেতরে ইহুদি ও গ্রিক, দাস ও স্বাধীন, নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো ভেদ নেই; সবাই এক। এই ধারণাই আধুনিক সার্বজনীন মানবাধিকারের চিন্তাকে ঐতিহাসিকভাবে প্রভাবিত করেছে। অথচ সাম্প্রতিক ক্যারল অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা দাবি করছেন, তাঁর আয়োজন নাকি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও খ্রিস্টীয় পরিচয় পুনরুদ্ধারের চেষ্টা। বাস্তবে, জাতিভিত্তিক গর্বের প্রচার আর যিশুর জন্মকাহিনির অন্তর্নিহিত বার্তার মধ্যে গভীর বিরোধ রয়েছে। একদিকে আছে নেটিভিজমের মহিমা, অন্যদিকে আছে নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা। এই দুইয়ের পার্থক্য স্পষ্টভাবে অনুধাবন করাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে জরুরি।



