যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে সম্প্রতি এক অভাবনীয় চিকিৎসা ঘটনা ঘটেছে, যা চিকিৎসক মহলসহ সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করেছে। ডিম্বাশয়ের বড় টিউমার অপসারণের জন্য এক নারীর অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি চলছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, দীর্ঘদিনের পেটব্যথা ও অনিয়মিত মাসিকের পেছনে রয়েছে একটি বড় সিস্ট বা টিউমার। কিন্তু অস্ত্রোপচারের ঠিক আগমুহূর্তে পরীক্ষায় যে তথ্য সামনে আসে, তা পুরো চিকিৎসা পরিকল্পনাকেই বদলে দেয়। শেষ পর্যন্ত টিউমার নয়, ওই নারীর পেট থেকে বেরিয়ে আসে একটি পূর্ণাঙ্গ ও জীবিত শিশু।
লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের একটি স্বনামধন্য মেডিকেল সেন্টারে গত ১৮ আগস্ট ৪১ বছর বয়সী এক নারীর অস্ত্রোপচার নির্ধারিত ছিল। তিনি কয়েক বছর ধরে অনিয়মিত মাসিক, পেটের ভেতর চাপ অনুভব এবং ব্যথার সমস্যায় ভুগছিলেন। বিভিন্ন পরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর ডিম্বাশয়ে প্রায় ২২ পাউন্ড ওজনের একটি বড় সিস্ট রয়েছে, যা দ্রুত অপসারণ প্রয়োজন। সেই অনুযায়ী অস্ত্রোপচারের দিন ঠিক করা হয়।
অস্ত্রোপচারের আগে নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষা ও ল্যাব টেস্ট করা হয়। এসব পরীক্ষার মধ্যেই একটি গর্ভধারণ পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসায় চিকিৎসকেরা চরম বিস্ময়ের মুখে পড়েন। কারণ, রোগীর শারীরিক উপসর্গ, দীর্ঘদিনের সমস্যার ইতিহাস এবং আগের স্ক্যান রিপোর্ট অনুযায়ী কেউই গর্ভধারণের বিষয়টি কল্পনা করেননি।
পরবর্তী সময়ে আলট্রাসাউন্ড ও এমআরআই স্ক্যান করে নিশ্চিত হওয়া যায়, ভ্রূণটি জরায়ুর ভেতরে অবস্থান করছে না। বরং এটি পেটের ভেতরে, একটি বড় টিউমারের পেছনে এবং যকৃতের কাছাকাছি স্থানে বেড়ে উঠেছে। চিকিৎসকেরা এই অবস্থাকে ‘অ্যাবডোমিনাল একটোপিক প্রেগন্যান্সি’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ ধরনের গর্ভধারণ অত্যন্ত বিরল এবং একই সঙ্গে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত।
সাধারণভাবে একটোপিক প্রেগন্যান্সিতে নিষিক্ত ডিম জরায়ুর বাইরে, যেমন ফ্যালোপিয়ান টিউব, রক্তনালি বা অন্য কোনো অঙ্গে সংযুক্ত হয়। এতে মায়ের শরীরে তীব্র রক্তক্ষরণ, অঙ্গহানি এমনকি প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের গর্ভধারণ শুরুর দিকেই ধরা পড়ে এবং পূর্ণ মেয়াদে পৌঁছানোর সুযোগ পায় না। তবে অল্প কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনায়, জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পূর্ণ মেয়াদে পৌঁছানো ভ্রূণকে জীবিত বের করা সম্ভব হয়।
এই বিশেষ অস্ত্রোপচারের দিনে প্রায় ৩০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক একসঙ্গে কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, সার্জন, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট এবং নবজাতক বিশেষজ্ঞরা। প্রথম ধাপে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বড় টিউমারটি অপসারণ করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে শিশুটিকে বের করা হয়। জন্মের সময় শিশুটির ওজন ছিল প্রায় আট পাউন্ড এবং তাকে সুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়।
অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর শরীর থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রক্তক্ষরণ হয়। দ্রুত রক্ত সরবরাহের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু সময় তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যার ফলে ধীরে ধীরে তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটে।
অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে মা ও নবজাতক দুজনেই সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তী সময়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, পূর্ণমেয়াদি অ্যাবডোমিনাল একটোপিক প্রেগন্যান্সি থেকে মা ও শিশুর নিরাপদ ফিরে আসা চিকিৎসাবিজ্ঞানে অত্যন্ত বিরল এবং উল্লেখযোগ্য সাফল্যের একটি উদাহরণ। এই ঘটনা আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার দক্ষতা, সমন্বিত টিমওয়ার্ক এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের গুরুত্ব নতুন করে সামনে এনেছে।



