ভেনিজুয়েলায় ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র আবারও চাপ বাড়াচ্ছে। জাহাজ জব্দ, নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আর সামরিক তৎপরতার মাধ্যমে দেশটির বর্তমান শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান আরও কঠোর করছে ওয়াশিংটন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যে কৌশল দেখা গিয়েছিল, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে সেটিরই পুনরাবৃত্তি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
প্রথম মেয়াদের শুরুর দিকে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে সরাতে ‘সামরিক বিকল্প’ নিয়ে প্রকাশ্যেই কথা বলেছিলেন ট্রাম্প। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসে, আড়ালে আক্রমণ বা আগ্রাসনের সম্ভাবনা নিয়ে তিনি ঘন ঘন আলোচনা করতেন। শেষ পর্যন্ত উপদেষ্টাদের চাপেই সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। তার বদলে নেওয়া হয় ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতি, যার মূল হাতিয়ার ছিল কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক হুমকি।
তবে এত কিছুর পরও ভেনিজুয়েলার শাসক ক্ষমতায় বহাল রয়েছেন। ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের সেই প্রচেষ্টা আবারও জোরালো হচ্ছে। ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮৯ সালে পানামা আগ্রাসনের পর সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে। পাশাপাশি মাদক বহনের অভিযোগে নৌযানে একাধিক হামলা চালানো হয়েছে। এসব অভিযানের সংখ্যা ২০ ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। গত মাসের শেষ দিকে ভেনিজুয়েলার শাসককে একটি চূড়ান্ত বার্তা দেওয়া হয়, যেখানে বলা হয়, তিনি যদি অবিলম্বে ক্ষমতা ছাড়েন, তবে নিরাপদে দেশ ছাড়ার সুযোগ পাবেন। এর আগেই তাঁর মাথার ওপর ৫০ মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। চলতি সপ্তাহে নতুন নিষেধাজ্ঞা আর একটি তেলবাহী ট্যাংকার জব্দ করার মাধ্যমে চাপ আরও বাড়ানো হয়।
২০১৩ সালে হুগো শাভেজের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসা ভেনিজুয়েলার এই প্রেসিডেন্ট গত জানুয়ারিতে তৃতীয় মেয়াদে শপথ নেন। যদিও গত বছরের নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী স্পষ্টভাবে এগিয়ে ছিলেন বলে শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবু যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থান মূলত নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রশ্নে নয়। প্রশাসনের দাবি, তারা মাদক চক্রের বিরুদ্ধে লড়ছে। কিন্তু সেই যুক্তি অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ ভেনিজুয়েলা যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত মাদকের বড় উৎপাদক বা প্রধান পরিবহনপথ নয়। উপরন্তু, সম্প্রতি মাদক সংক্রান্ত বড় অপরাধে দণ্ডিত এক সাবেক মধ্য আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে ক্ষমা করার ঘটনাও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
ভেনিজুয়েলার দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক বিপর্যয় সাধারণ মানুষকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। প্রায় ৮০ লাখ মানুষ দেশ ত্যাগ করেছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৭ লাখ যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন প্রবাহ কমাতে চাইলেও বিশ্লেষকদের মতে, ভেনিজুয়েলার ওপর আরও চাপ সৃষ্টি বা সরকার উৎখাতের চেষ্টা পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে এবং শরণার্থী স্রোত বাড়ার আশঙ্কাই বেশি।
ট্যাংকার জব্দের সিদ্ধান্ত ভেনিজুয়েলার শাসকের সেই অভিযোগকে জোরদার করেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য তেল। যদিও বাস্তবতায় দেশটির কাছে বিশ্বের মোট প্রমাণিত তেল মজুতের বড় অংশ থাকলেও উৎপাদনের হার এক শতাংশেরও কম।
ভেনিজুয়েলার বিরোধী রাজনীতির পরিচিত মুখ ও নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত এক নেত্রী যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপকে প্রয়োজনীয় বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আগে থেকেই ব্যাপক বেসরকারিকরণ পরিকল্পনার কথা বলে আসছেন, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় সুযোগের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকায় চীনের প্রভাব বাড়া নিয়েও উদ্বিগ্ন। ভেনিজুয়েলা ইতোমধ্যে বেইজিংয়ের সঙ্গে জ্বালানি ও খনিজ খাতে একাধিক চুক্তি করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রকে খনিজ সম্পদের প্রবেশাধিকার দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল, তবে তাতে ওয়াশিংটনের অবস্থানে পরিবর্তন আসেনি।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রথম দফায় সরকার পরিবর্তনে ব্যর্থ হওয়ার হতাশাও এই নতুন কঠোরতার পেছনে কাজ করছে। যদিও কূটনৈতিক আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, প্রশাসনের ভেতরে লাতিন আমেরিকার বামপন্থী সরকারগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার প্রবণতাই বেশি দৃশ্যমান। পূর্ণমাত্রার সামরিক আগ্রাসন এখনই সম্ভাব্য না হলেও সীমিত স্থল হামলার ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বিরোধী দলগুলো সতর্ক করে বলছে, এই পথে এগোলে ভেনিজুয়েলার সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা, একঘরে করে রাখা আর অর্থনৈতিক ধস যেখানে সফল হয়নি, সেখানে আরও চাপ দিয়ে ভিন্ন ফল আসবে এমন বিশ্বাসের যথেষ্ট কারণ দেখছেন না পর্যবেক্ষকেরা।



