Saturday, December 27, 2025
spot_img
Homeঅন্যান্যতুরস্কের কৌশলে জিহাদি নেতা থেকে রাষ্ট্রনেতা

তুরস্কের কৌশলে জিহাদি নেতা থেকে রাষ্ট্রনেতা

২০১৯ সালের বসন্তে সিরিয়ার ইদলিবে পরিস্থিতি খুবই সংকটজনক হয়ে ওঠে। রাশিয়ার বিমানবাহিনীর সহায়তায় সরকারি বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। তখন হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) শীর্ষ নেতা তাঁর নিরাপদ আবাসে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও বিদেশি অতিথি নিয়ে বসেছিলেন। উপস্থিত ছিলেন একজন তুর্কি প্রতিনিধি।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে শুরু করেন। ছোটবেলার একটি স্বপ্নের কথা তিনি বলেছিলেন, যেখানে তিনি দামেস্কের আমির হয়েছেন। এটি তাঁর জন্য ছিল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত, যা তাকে শক্তি জুগিয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট স্বৈরশাসক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কঠিন হলেও শেষ পর্যন্ত বিজয় সম্ভব। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাও তাঁর এই বিশ্বাসে সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন।

প্রায় পাঁচ বছর পর, এই নেতা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট বা ‘আমির’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। ছোটবেলার পরিচয় থেকে ৪৩ বছরের এই নেতা দ্রুত নিজেকে নতুন ভূমিকায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন। একসময় ‘জিহাদি’ হিসেবে পরিচিত থাকলেও তিনি এখন রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘসময় আল-কায়েদা ঘরানার বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীতে সক্রিয় থাকার পর এমন রূপান্তর অনন্য।

ক্ষমতায় ওঠার পর তিনি আন্তর্জাতিক নেতাদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেন, জনসমক্ষে স্ত্রীসহ উপস্থিত হন, ঐতিহ্যবাহী পোশাক বদলে স্যুট-টাই পরেন। সব মিলিয়ে তিনি এমন একটি নতুন রাষ্ট্র গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন, যেখানে স্পষ্ট ইসলামি প্রভাব নেই।

এই রূপান্তরের পেছনে তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইদলিবে শাসনকালে তাঁর ক্ষমতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিত্ব ও ভূমিকার পরিবর্তনও ঘটে। একজন তুর্কি কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, এই নেতা যখন ইদলিবে নিজের দলের উগ্রপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন, তখন তার বাস্তববাদী দিকও প্রকাশ পায়।

তুরস্কের সঙ্গে প্রথম বড় যোগাযোগ শুরু হয় ২০১৭ সালে। তখন এইচটিএস ইদলিবের গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তচৌকি দখল করে। তুরস্ক সেই সীমান্ত বন্ধ করতে চাইলে এই নেতা একটি বেসামরিক প্রশাসন গঠন করেন। এই প্রশাসন এলাকার নিরাপত্তা এবং মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করে, যা তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে।

তুরস্কের উদ্দেশ্য ছিল, একক কোনো গোষ্ঠীর আধিপত্যে ইদলিবে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। এটি মেনে নিয়ে এই নেতা তাঁর দলের মধ্যে একীকরণ ঘটান। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এইচটিএস প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলিকে যুক্ত করে ‘আরও বেশি সিরীয়’ পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর ইদলিবের বেসামরিক প্রশাসন বা সালভেশন গভর্নমেন্ট গঠিত হয়, যা তুরস্ককে সহযোগিতা করার সুযোগ দেয়।

এই সময়ে তুরস্কের প্রভাব দুই দিকে কাজ করে। প্রথমে এটি এইচটিএসকে বৈধভাবে পরিচিত করতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, তুরস্কের সাহায্যে এই নেতা তার দলের মধ্যে কট্টরপন্থী সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ ও সরিয়ে দিতে সক্ষম হন। এছাড়া তুরস্ক নিশ্চিত করে যে ইদলিবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও বিদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকে।

২০২০ সালে আসাদ বাহিনী নতুন অভিযান শুরু করলে তুরস্ক সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে এইচটিএসের সঙ্গে বাস্তবিক সম্পর্ক তৈরি হয়, যা দলের চরিত্রে পরিবর্তন আনে। সংগঠনটি নিজেকে জনসমক্ষে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে শুরু করে এবং কট্টরপন্থী গোষ্ঠী ‘হুররাস আল-দিন’-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এতে প্রমাণিত হয়, সংগঠনটি আল-কায়েদা থেকে আলাদা।

এই সময় পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সংযোগও গড়ে ওঠে। তুরস্কের মধ্যস্থতায় ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় কর্মকর্তারা মানবিক সহায়তার বিষয়ে এই নেতা বা তার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেন। এতে আন্তর্জাতিকভাবে এইচটিএস সম্পর্কে দীর্ঘদিনের ‘সন্ত্রাসী’ ধারণা দুর্বল হয়।

২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে দেয়, যা তুরস্ক ও এইচটিএসের অবস্থান আরও দৃঢ় করে। ইদলিবে সামরিক একাডেমি ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু হয়, যা বিদেশি যোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগায়। ২০২৩ সালে পশ্চিমা দেশগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কর্মশালার মাধ্যমে সংগঠনের বৈধতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

২০২৪ সালের নভেম্বরে রাশিয়ার চাপ ও সিরিয়ার সামরিক পরিস্থিতি তুরস্ককে ইদলিবে হস্তক্ষেপের অনুমতি দিতে বাধ্য করে। এই নেতা একটির পর একটি শহর দখল করে ক্ষমতা প্রসারিত করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি জনসমক্ষে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন, তাঁর বিপ্লব সফল হয়েছে এবং ইতিহাস লেখা হচ্ছে।

ইদলিবের সাধারণ মানুষের সুরক্ষা, কট্টরপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ন্ত্রণ ও বেসামরিক প্রশাসনের মাধ্যমে তিনি নিজেকে ‘রাষ্ট্রনেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তুরস্কের কৌশল এবং দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতার মাধ্যমে এই নেতা জিহাদি থেকে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে রূপান্তরিত হয়েছেন, যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments