বিশ্ববাজারে সোনার দামের ঊর্ধ্বমুখী ধারা থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে দাম বাড়ার পর চলতি বছর সোনার দাম আউন্সপ্রতি চার হাজার ডলার অতিক্রম করে নতুন রেকর্ড গড়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাস বলছে, এই প্রবণতা ২০২৬ সালেও অব্যাহত থাকতে পারে এবং সোনার দাম আরও উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।
সোনার দাম চার হাজার ডলার ছাড়ানোর পরই একাধিক বিশ্লেষক সংস্থা মূল্যবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়। সর্বশেষ একটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ব্যাংকের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালের শেষ দিকে বিশ্ববাজারে সোনার দাম আউন্সপ্রতি প্রায় ৪ হাজার ৯০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। সাম্প্রতিক দুই মাসে প্রকাশিত বিভিন্ন পূর্বাভাসেও প্রায় একই চিত্র উঠে এসেছে। এসব প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, আগামী বছর সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার ৯০০ ডলারের মধ্যে অবস্থান করতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে সোনায় প্রত্যাশিত মাত্রায় বিনিয়োগ এখনো হয়নি। সে কারণে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশকে সোনার দিকে আরও ঝুঁকতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে সোনা ধরে রাখার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম। ফলে ভবিষ্যতে হঠাৎ করে যদি সোনায় বিনিয়োগ বাড়ে, তাহলে দামের বড় ধরনের লাফ দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাজার বিশ্লেষণে আরও বলা হয়েছে, সোনার দাম বাড়ার জন্য এখন অতিরিক্ত চাহিদার বিস্ফোরণ প্রয়োজন নেই। বরং বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পাশাপাশি সামান্য পরিমাণে সোনা কিনলেও এর প্রভাব পড়তে পারে দামের ওপর। ফলে বিনিয়োগ যতটা বাড়বে, দামের বৃদ্ধি তার চেয়েও বেশি হারে হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চলতি বছর ইতিমধ্যে সোনার দাম প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, চলতি বছরের বাকি সময়ে দাম বৃদ্ধির গতি কিছুটা কম হতে পারে। তবে যেসব কারণ সোনার দাম বাড়িয়েছে, সেগুলো এখনো বহাল রয়েছে এবং নিকট ভবিষ্যতে সেগুলো দূর হওয়ার সম্ভাবনা কম।
প্রথম কারণ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনা কেনার প্রবণতা। ২০২২ সালে একটি বড় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ পশ্চিমা দেশগুলো জব্দ করার ঘটনার পর অনেক দেশের নীতিনির্ধারকেরা উপলব্ধি করেন যে, বৈদেশিক মুদ্রার পাশাপাশি সোনার মজুত বাড়ানো জরুরি। এর পর থেকে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে সোনা কিনছে। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপে বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রায় ৪৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সোনার রিজার্ভ আরও বাড়াতে আগ্রহী।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো সুদহার নীতি। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার কমানোর পথে রয়েছে এবং ডিসেম্বর মাসেও সুদ কমানো হয়েছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, ২০২৬ সালে আরও প্রায় ৭৫ ভিত্তি পয়েন্ট সুদহার কমানো হতে পারে। সুদহার কমলে সাধারণত সোনার মতো নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যমের প্রতি আগ্রহ বাড়ে, যা অতীতেও দেখা গেছে।
এ ছাড়া বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বাণিজ্যে অস্থিরতা বাড়ায় অনেক বিনিয়োগকারী ডলারভিত্তিক বন্ডের তুলনায় সোনাকে বেশি নিরাপদ মনে করছেন। বিশেষ করে বাণিজ্য নীতিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকির ধারণা বাড়িয়ে দিয়েছে।
সোনার আরেকটি বড় সুবিধা হলো দীর্ঘমেয়াদে এর দাম সাধারণত নিম্নমুখী হয় না। একটি আন্তর্জাতিক তথ্যভিত্তিক সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০ বছরে সোনার দাম বেড়েছে ৭১৮ শতাংশের বেশি। গত পাঁচ বছরে দাম বেড়েছে প্রায় ১৩৪ শতাংশ এবং এক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে ৬১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এসব তথ্য সোনাকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হিসেবে আরও আকর্ষণীয় করে তুলছে।



