কিয়েভের ঐতিহাসিক সোফিয়া স্কয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় ক্রিসমাস ট্রিটি এখনো যুদ্ধবিধ্বস্ত বাস্তবতার মাঝেও এক ধরনের প্রতীক হয়ে আছে। সেই চত্বরে পাথুরে পথ ধরে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলেন, রুশ সেনারা ইউক্রেনীয় বাহিনীকে ভয় পায়। তাঁর দাবি, শত্রুপক্ষের পরিখায় সরাসরি ঢুকে পড়ার অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি এই উপলব্ধি পেয়েছেন। তবে এই ভয় যুদ্ধের গতিপথ একতরফাভাবে বদলে দিতে পারবে কি না, সে বিষয়ে তিনি নিজেও নিশ্চিত নন।
ওই সেনা কর্মকর্তার মতে, রাশিয়ার সেনাসংখ্যা বেশি, অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী এবং দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার মতো আর্থিক সক্ষমতাও তাদের রয়েছে। বিপরীতে ইউক্রেন এখনো জনবল ও আধুনিক অস্ত্রের দিক থেকে পিছিয়ে আছে। যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি জানান, শত্রুপক্ষের ট্যাংকের অবস্থান চিহ্নিত করলেও অনেক সময় তা ধ্বংস করার মতো অস্ত্র বা গোলাবারুদ সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায় না। এতে সামরিক বাস্তবতার কঠিন দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
২০২৩ সালে স্থলমাইন বিস্ফোরণে একটি পা হারানোর আগপর্যন্ত তিনি সম্মুখসমরে ছিলেন। বর্তমানে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে না থাকলেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত আছেন। যুদ্ধকালীন বিধি মেনে তিনি নিজের নামের পূর্ণ পরিচয় প্রকাশ করেননি।
এদিকে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত দেখা যাচ্ছে। কিয়েভভিত্তিক একটি চিন্তক প্রতিষ্ঠানের প্রধান মনে করেন, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইউক্রেনকে হয়তো দোনেৎস্ক অঞ্চলের কিয়েভ নিয়ন্ত্রিত অংশ ছেড়ে দিতে হতে পারে। এর বিনিময়ে রাশিয়া পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে পারে। এই সমঝোতা না হলে সংঘাত ২০২৭ সাল পর্যন্ত গড়ানোর আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তিনি।
অন্যদিকে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মনে করেন, পূর্ণাঙ্গ শান্তির চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখাই হতে পারে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত লক্ষ্য। তাঁর ভাষায়, এমন আগ্রাসী প্রতিবেশী থাকলে যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে, এমন আশা করা কঠিন। ১৯৯১ সালে নির্ধারিত সীমানার ভেতরে থাকা সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার না করা পর্যন্ত প্রকৃত শান্তি সম্ভব নয় বলেও তিনি মত দেন।
এই সাবেক কর্মকর্তা আরও বলেন, ভবিষ্যতে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘিত হলে ইউক্রেনকে সামরিকভাবেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সে জন্য দেশীয় অস্ত্র উৎপাদন বাড়ানো, সেনা সমাবেশ জোরদার করা এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে যুদ্ধকালীন চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর মতে, বর্তমানে ইউক্রেনের সামরিক শিল্প খাত নিজস্ব চাহিদার একটি অংশ পূরণ করতে পারলেও বড় অংশ এখনো পশ্চিমা মিত্রদের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।
অন্য বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ২০২৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধে শান্তিচুক্তির একটি সম্ভাব্য সুযোগ তৈরি হতে পারে। যদি যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া অগ্রগতি অর্জনে ব্যর্থ হয় এবং বুঝতে পারে যে ইউক্রেন দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে সক্ষম, তখন মস্কো আলোচনার পথে যেতে পারে। তবে এই সিদ্ধান্ত অনেকটাই নির্ভর করবে রাশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্মতির ওপর।
বিশ্লেষকদের মতে, এমনকি সম্মতি এলেও উভয় পক্ষের প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তিত বাস্তবতা, পশ্চিমা জোটের ভূমিকার রূপান্তর এবং এশিয়ায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধিও এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কিছু বিশ্লেষক অতীতের উদাহরণ টেনে সতর্ক করছেন যে, ইউক্রেনের ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ড বা জর্জিয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে দখল করা অঞ্চলগুলোর ওপর ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, আবার সেগুলোকে রাশিয়ার অংশ হিসেবেও স্বীকার করা হবে না। আবার আরেকটি সম্ভাবনা হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ স্থগিত থাকা এবং আলোচনা চলতে থাকার কথাও উঠে আসছে।
তবে জার্মানির এক গবেষকের মতে, যুদ্ধ থামার সম্ভাবনা তৈরি হবে কেবল তখনই, যদি ইউক্রেন দক্ষিণ-পূর্ব দোনেৎস্ক অঞ্চলের বাকি অংশসহ আরও কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারানোর বাস্তবতা মেনে নেয়। তাঁর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে চাপে ফেলতে পুরোপুরি কার্যকর হয়নি, কারণ অনেক দেশই সেই নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে মস্কোর হাতে আরও কিছু সময় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো সম্পদ রয়েছে।
এই দীর্ঘ সংঘাতে সাধারণ ইউক্রেনীয় নাগরিকরাও ক্রমেই ক্লান্ত। রুশ গোলাবর্ষণ, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও অর্থনৈতিক সংকট তাদের দৈনন্দিন জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। এক প্রবীণ ইউক্রেনীয় নাগরিকের ভাষায়, তিনি চান পাখির ডাক শুনে ঘুম ভাঙুক, ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোনের শব্দে নয়। এই আকাঙ্ক্ষাই হয়তো যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের মনের কথা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।



