Saturday, December 27, 2025
spot_img
Homeবিজনেসসোনার বাজারে রেকর্ড উত্থান ২০২৫

সোনার বাজারে রেকর্ড উত্থান ২০২৫

১৯৭৯ সালের পর সোনার বাজারে সবচেয়ে শক্তিশালী সময় পার করছে বিশ্ব। চলতি বছরে নিউইয়র্কে সোনার আগাম লেনদেনের বাজারে মূল্যবান এই ধাতুর দাম বেড়েছে ৭১ শতাংশ, যা প্রায় সাড়ে চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ বার্ষিক উত্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সোনার প্রতি আগ্রহ আবারও স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে।

এর আগে এক বছরে সবচেয়ে বড় উত্থান দেখা গিয়েছিল ১৯৭৯ সালে। সে সময় মধ্যপ্রাচ্যে টানা অস্থিরতা চলছিল, ইরানে ঘটে যায় ইসলামি বিপ্লব, যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র জ্বালানিসংকট দেখা দেয় এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। সেই বহুমাত্রিক সংকটের বছরে সোনার দাম বেড়েছিল ১২৬ শতাংশ। বছরের শুরুতে যেখানে আউন্সপ্রতি দাম ছিল ২২৬ ডলার, বছরের শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১২ ডলারে। এরপর দীর্ঘ ৪৬ বছরে আর কোনো বছরে সোনার দাম এত বড় লাফ দেয়নি।

বর্তমান পরিস্থিতিও ভিন্ন হলেও সংকটমুক্ত নয়। এখনকার প্রধান উদ্বেগের জায়গা হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক যুদ্ধের আশঙ্কা, রাশিয়া ও ইউক্রেনের চলমান সংঘাত এবং বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে নতুন অনিশ্চয়তা। এর পাশাপাশি কিছু তেলবাহী ট্যাংকার আটকানোর ঘটনায় আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ নিয়ে নতুন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এসব বিষয় বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ থেকে দূরে সরিয়ে তুলনামূলক নিরাপদ বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করছে।

বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা হলো, সংকট যত বাড়ে সোনার চাহিদা তত বৃদ্ধি পায়। মূল্যস্ফীতি বাড়ুক বা কমুক, ডলারের মান শক্তিশালী হোক বা দুর্বল হোক, সোনার দাম সাধারণত বড় ধরনের পতনের মুখে পড়ে না। এই বিশ্বাস থেকেই চলতি বছরে সোনার বাজারে ব্যাপক উত্থান দেখা যাচ্ছে।

বছরের শুরুতে আউন্সপ্রতি সোনার আগাম দাম ছিল প্রায় ২ হাজার ৬৪০ ডলার। বছর শেষের দিকে এসে সেই দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ ডলারে। বড় বিনিয়োগ ব্যাংকগুলোর বিশ্লেষণে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৬ সালে আউন্সপ্রতি সোনার দাম পাঁচ হাজার ডলারে পৌঁছাতে পারে।

চলতি বছরে সোনার এই উত্থান অন্য সব প্রধান বিনিয়োগ মাধ্যমকে পেছনে ফেলেছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের প্রধান সূচকের বৃদ্ধি ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ। আগের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে সোনার আগাম লেনদেনে মুনাফা ছিল ২৭ শতাংশ, যেখানে শেয়ারবাজারের মুনাফা ছিল ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে সোনা বিনিয়োগকারীদের জন্য তুলনামূলক ভালো ফল দিচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভবিষ্যতে সুদহার আরও কমার সম্ভাবনা সোনার দামের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি মার্কিন ডলার দুর্বল হওয়ায় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে সোনা তুলনামূলকভাবে সস্তা হয়ে উঠছে, যা চাহিদা বাড়ানোর আরেকটি কারণ।

সোনার দামের এই উত্থানের পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সোনার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে এশিয়ার বড় অর্থনীতিগুলো মার্কিন ট্রেজারি ও ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সোনার দিকে ঝুঁকছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর পশ্চিমা দেশগুলো ডলারে সংরক্ষিত কিছু সম্পদ জব্দ করায় এই প্রবণতা আরও জোরালো হয়। এতে অনেক দেশ ডলারে বিনিয়োগের ঝুঁকি নতুন করে মূল্যায়ন করতে শুরু করে।

পণ্যবাজার বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, সার্বভৌম রিজার্ভ জব্দ হওয়ার আশঙ্কা এবং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার বিভাজন সোনার চাহিদায় একটি নতুন কাঠামোগত মাত্রা যোগ করেছে। এই প্রবণতা স্বল্পমেয়াদি নয়, বরং দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো প্রতিবছর এক হাজার টনের বেশি সোনা কিনেছে। অথচ এর আগের এক দশকে এই পরিমাণ ছিল বছরে মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ টন। এই পরিসংখ্যানই স্পষ্ট করে দেয়, কেন সোনার বাজার বর্তমানে এত শক্ত অবস্থানে রয়েছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments