Sunday, December 21, 2025
spot_img
Homeআপনার স্বাস্থ্যসুপারমার্কেট ভরা অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারে

সুপারমার্কেট ভরা অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারে

প্রতিদিনের কেনাকাটায় যাঁরা নিয়মিত সুপারমার্কেটে যান, তাঁদের অনেকেরই অজান্তে ঝুড়িতে ঢুকে পড়ছে অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার। সাম্প্রতিক গবেষণা ও বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, একটি সাধারণ মুদি দোকানে পরিবারের জন্য যেসব খাবার পাওয়া যায়, তার প্রায় ৭০ শতাংশই অতিপ্রক্রিয়াজাত শ্রেণির। প্রশ্ন হলো, ভোক্তারা কি বিষয়টি জানেন এবং জানলেও সেসব খাবার এড়িয়ে চলার বাস্তব কোনো উপায় আছে কি না।

স্বাস্থ্য ও জীবনধারা বিষয়ক প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক ও গবেষকেরা দীর্ঘদিন ধরে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন। অসংখ্য গবেষণা পর্যালোচনা, পুষ্টিবিদ ও খাদ্যবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলা এবং নানা অ্যাপ ও গাইড ব্যবহার করেও বাস্তবতা হলো, সাধারণ ক্রেতার পক্ষে নির্ভরযোগ্যভাবে অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা এখনো কঠিন।

এক সময় যেগুলোকে ‘জাঙ্ক ফুড’ বলা হতো, সেগুলোর আকর্ষণ কমেনি, বরং বেড়েছে। চিনি, লবণ ও চর্বির এমন সংমিশ্রণ তৈরি করা হচ্ছে, যা মানুষকে বারবার খেতে প্রলুব্ধ করে। খাদ্যশিল্পের উন্নত অ্যালগরিদম ভোক্তার রুচি ও অভ্যাস বিশ্লেষণ করে এই ‘ব্লিস পয়েন্ট’ ঠিক করে দিচ্ছে। ফলে একটি বিস্কুট বা চিপসের প্যাকেট খুললে ‘একটিতে থামা’ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

বর্তমান সময়ে অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারের তালিকায় শুধু চিপস বা ক্যান্ডিই নয়, রয়েছে রেডি টু ইট মিল, প্রক্রিয়াজাত মাংস, ইনস্ট্যান্ট মিক্স, ব্রেকফাস্ট সিরিয়ালসহ আরও অনেক পণ্য। এসব খাবারে কৃত্রিম স্বাদ, রং, টেক্সচার ও সংরক্ষণকারী উপাদান ব্যবহার করা হয়, যা খাবারকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ এমনকি বছরের পর বছর ভালো রাখে। এই দীর্ঘস্থায়িত্ব ও সহজলভ্যতা আধুনিক জীবনে সুবিধা এনে দিলেও, স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রশ্নও তুলে ধরছে।

খাদ্য শ্রেণিবিন্যাসের বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতিতে খাবারকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ধাপে রয়েছে অল্প প্রক্রিয়াজাত বা প্রায় অপরিবর্তিত খাবার, যেমন কাটা ফল বা রান্না করা সবজি। দ্বিতীয় ধাপে রান্নায় ব্যবহৃত তেল, মসলা ও লবণের মতো উপাদান। তৃতীয় ধাপে আছে প্রক্রিয়াজাত খাবার, যেমন ক্যানজাত সবজি বা তাজা বেক করা পাউরুটি। চতুর্থ ধাপেই পড়ে অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার, যেখানে পুরো খাবারের উপস্থিতি খুবই কম বা প্রায় নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের খাদ্যের প্রায় অর্ধেকের বেশি এবং শিশুদের খাদ্যের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই এই অতিপ্রক্রিয়াজাত শ্রেণির। পুষ্টিবিদদের মতে, এসব খাবার মূলত সস্তা কাঁচামালকে রাসায়নিকভাবে ভেঙে আবার জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হয়। এতে প্রাকৃতিক খাদ্যগঠন নষ্ট হয়, ফাইবার ও ক্ষুদ্র পুষ্টি উপাদান কমে যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে মাত্র ১০ শতাংশ বেশি ক্যালরি গ্রহণ করলেও হৃদ্‌রোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে। স্থূলতা, টাইপ টু ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, মানসিক অবক্ষয় এবং কিছু ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা বলছেন, ‘অতিপ্রক্রিয়াজাত’ শব্দটির কোনো সর্বসম্মত বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা নেই এবং শুধু প্রক্রিয়াজাত বলেই খাবারকে অস্বাস্থ্যকর বলা বিভ্রান্তিকর।

অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার তৈরির পদ্ধতিও প্রশ্নবিদ্ধ। ভুট্টা, গম, আলু বা সয়াবিনের মতো শস্যকে ভেঙে স্টার্চ, তেল ও প্রোটিন আলাদা করা হয়। এরপর কৃত্রিম উপাদান যোগ করে নতুন রূপ দেওয়া হয়। অনেক বিশেষজ্ঞ একে ‘খাবারের মায়া’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, কারণ দেখতে খাবারের মতো হলেও এর ভেতরের গঠন প্রকৃত খাবারের মতো থাকে না।

সুপারমার্কেটে পাওয়া তথাকথিত স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস, যেমন সবজি দিয়ে তৈরি স্ট্র, সেগুলোও উপাদান তালিকা দেখলে অতিপ্রক্রিয়াজাত হিসেবে চিহ্নিত হয়। অর্গানিক লেবেল থাকলেও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাত্রা কমে না। একইভাবে, কম উপাদান থাকা মানেই খাবার স্বাস্থ্যকর, এমনও নয়। তিন উপাদানের আলুর চিপস প্রক্রিয়াজাত না হলেও তা পুষ্টিকর হয়ে যায় না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, লেবেল পড়ার অভ্যাস জরুরি হলেও এটি পূর্ণ সমাধান নয়। চিনি, লবণ ও চর্বির পরিমাণ, পরিবেশন মাত্রা এবং উপাদানের ক্রম খেয়াল করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যে অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবার নিয়ে নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। কোথাও কোথাও স্কুলের খাবার থেকে ক্ষতিকর অতিপ্রক্রিয়াজাত পণ্য ধাপে ধাপে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে।

সব মিলিয়ে, আধুনিক জীবনে সস্তা ও সহজ খাবার এড়িয়ে চলা কঠিন হলেও সচেতনতা বাড়ানো এবং নীতিগত পরিবর্তন ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। খাদ্যব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জনস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যতে অতিপ্রক্রিয়াজাত খাবারই প্রধান খাদ্যে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments