গণিতের বিস্তৃত জগতে কোন সংখ্যা সবচেয়ে প্রভাবশালী, এ প্রশ্ন বহুদিন ধরেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কেউ কেউ এককে মৌলিক সংখ্যা হিসেবে তুলে ধরেন, আবার অনেকে পাইয়ের মতো ধ্রুবককে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানী ও গণিতবিদের মধ্যে একটি বিষয়ে স্পষ্ট ঐকমত্য রয়েছে, তা হলো শূন্য বা জিরোই সমগ্র গণিতব্যবস্থার ভিত্তি। শূন্য কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি একটি মৌলিক ধারণা, যা মানব সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রযাত্রাকে নতুন দিশা দেখিয়েছে।
সংখ্যা হিসেবে শূন্যের ধারণাকে মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক আবিষ্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রাচীনকালে বিভিন্ন সভ্যতায় গণনার পদ্ধতি প্রচলিত থাকলেও সেখানে শূন্যকে আলাদা কোনো সংখ্যা বা ধারণা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তখনকার গণনায় কোনো কিছুর অনুপস্থিতি বোঝাতে নির্দিষ্ট প্রতীক বা গাণিতিক নিয়ম ছিল না। ফলে সংখ্যা প্রকাশ ও হিসাব ছিল সীমিত এবং জটিল।
শূন্যকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংখ্যা হিসেবে ব্যবহারের সূচনা ঘটে ভারতবর্ষে। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ভারতীয় গণিতবিদেরা শূন্যকে শুধু শূন্যতা বা অনুপস্থিতির প্রতীক হিসেবে নয়, বরং একটি কার্যকর গাণিতিক উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এই ধারণা পরবর্তীতে আরব বিশ্ব হয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং আধুনিক গণিতের ভিত গড়ে তোলে। শূন্যের এই স্বীকৃতি গণনার ভাষাকেই আমূল বদলে দেয়।
শূন্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার একটি হলো স্থানধারক হিসেবে এর ব্যবহার। স্থানীয় মান ব্যবস্থায় শূন্য অপরিহার্য। একটি সংখ্যার মান নির্ধারণে কোন অঙ্কটি কোথায় বসেছে, তা বোঝাতে শূন্যের ভূমিকা মৌলিক। এক ও দশ, একশ ও এক হাজারের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয় মূলত শূন্যের অবস্থানের কারণে। শূন্য ছাড়া বড় ও জটিল সংখ্যা লিখে প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব হতো। এই স্থানধারক ধারণাই গণনাকে সহজ, দ্রুত এবং নির্ভুল করে তুলেছে।
গণিতের উচ্চতর শাখাগুলোর বিকাশেও শূন্যের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বীজগণিতে সমীকরণ সমাধানের ক্ষেত্রে শূন্য একটি কেন্দ্রীয় ধারণা। কোনো সমীকরণের সমাধান নির্ণয়ে প্রায়ই ফলাফলকে শূন্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়। অনেক গাণিতিক সমস্যার মূল নির্ভর করে কোথায় মান শূন্যে পৌঁছাচ্ছে, তার ওপর। একইভাবে ক্যালকুলাসের বিকাশেও শূন্যের ধারণা গভীরভাবে জড়িত। সীমা, অবকলন ও সমাকলনের মতো ধারণাগুলো অসীমভাবে ক্ষুদ্র পরিবর্তন নিয়ে কাজ করে, যার মূলে রয়েছে শূন্যের ধারণা।
শুধু তাত্ত্বিক গণিতেই নয়, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতেও শূন্যের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বর্তমান ডিজিটাল বিশ্ব সম্পূর্ণভাবে শূন্যের ওপর নির্ভরশীল। কম্পিউটার প্রযুক্তির ভিত্তি হলো বাইনারি পদ্ধতি, যেখানে কেবল দুটি প্রতীক ব্যবহৃত হয়, শূন্য ও এক। এই দুই অঙ্কের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে তথ্য সংরক্ষণ, সফটওয়্যার, ইন্টারনেট এবং আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা। শূন্যের ধারণা ছাড়া আধুনিক কম্পিউটিং কল্পনাই করা যেত না।
সব মিলিয়ে, শূন্য মানে কেবল কিছুই নেই, এমন ধারণা সঠিক নয়। এটি মানব জ্ঞানের বিকাশে এক নীরব বিপ্লব। শূন্যের মাধ্যমে মানুষ জটিল সংখ্যা বুঝতে শিখেছে, প্রকৃতির নিয়ম ব্যাখ্যা করেছে এবং প্রযুক্তির সাহায্যে পৃথিবীকে নতুনভাবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে। এই সাধারণ অথচ শক্তিশালী সংখ্যাই গণিতকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর ভাষায় পরিণত করেছে।



