মানব সমাজের অগ্রযাত্রা সম্পর্ক, সহমর্মিতা ও দায়িত্ববোধের সুতোয় গাঁথা। সময় যতই বদলাক, মানবতাবাদী মূল্যবোধের প্রয়োজন ততই বাড়ছে। এই উপলব্ধিকে কেন্দ্র করে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা এবং একটি মানবতাবাদী আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো একটি ব্যতিক্রমী কমিউনিটি সংযোগ অনুষ্ঠান। ১২ ডিসেম্বর শুক্রবার নিউইয়র্কে আয়োজিত এই আয়োজনটি প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা সুধিজনদের অংশগ্রহণে চার ঘণ্টাব্যাপী এক স্মরণীয় মিলনমেলায় পরিণত হয়। মানুষ, সমাজ, সময় এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে আলোকিতজনদের অভিজ্ঞতা বিনিময় ছিল পুরো আয়োজনের মূল সুর।
নিউইয়র্কের গুলশান টেরেসে সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা থেকে অতিথিদের আগমন শুরু হয়। আয়োজকদের পক্ষ থেকে অতিথিদের আন্তরিক অভ্যর্থনা ও উপহার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানের সূচনা পর্বে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভায় শিক্ষানবিশ হিসেবে কর্মরত তরুণ উপস্থাপক দক্ষ সঞ্চালনার মাধ্যমে সম্পাদককে মঞ্চে আহ্বান জানান। এর মধ্যেই চারজন সিটি কাউন্সিল সদস্য, নগর প্রশাসনের প্রতিনিধিসহ কমিউনিটির অগ্রগণ্য ব্যক্তিবর্গ আসন গ্রহণ করেন।
সম্পাদক তাঁর বক্তব্যে এই উদ্যোগে সহযোগিতার জন্য মানবতাবাদী সংগঠনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রবাসে এমন বহু মানুষ আছেন যারা নীরবে সমাজের জন্য কাজ করে যান, কিন্তু সামনে আসতে চান না। তাদের খুঁজে বের করা, তাদের মধ্যে সংযোগ তৈরি করা এবং সমাজ ও মানুষের কল্যাণে ইতিবাচক উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা অবিচল থাকবে।
এরপর নির্বাহী সম্পাদক কমিউনিটি বিনির্মাণে পত্রিকাটির ভূমিকা নিয়ে একটি ভিডিও প্রদর্শনের আহ্বান জানান। স্বাগত বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেন, একটি মাত্র আয়োজনেই শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে না। তবে নিয়মিত কার্যক্রম ও পারস্পরিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে এই সংযোগ সময়ের সঙ্গে অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে।
পরবর্তীতে মানবতাবাদী সংস্থাটির বিশ্বজুড়ে বিপন্ন মানুষের জন্য পরিচালিত কার্যক্রম নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও দেখানো হয়। এরপর সংস্থাটির যুক্তরাষ্ট্র শাখার নির্বাহী প্রধান বলেন, এই সন্ধ্যা মূলত সংযোগের। একে অন্যকে নতুন করে জানা, গল্প শোনা, অভিজ্ঞতা থেকে শেখা এবং ভবিষ্যৎ অভিযাত্রায় সবাইকে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ জানানোর একটি উপলক্ষ। তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জলবায়ু সহনশীলতা ও অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরিতে প্রবাসীদের সমর্থন যে শুধু উত্তর আমেরিকায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং বাংলাদেশের পরিবার, শিশু ও তরুণদের কাছেও পৌঁছাতে পারে, সে কথাও তুলে ধরেন।
আন্তর্জাতিক সংস্থাটির চেয়ারম্যান বিশেষভাবে কানাডা থেকে নিউইয়র্কে এসে অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তাঁর বক্তব্যে তিনি বিশ্বজুড়ে সংকটে থাকা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সংগঠনের দীর্ঘদিনের কাজ ও অঙ্গীকার তুলে ধরেন এবং এমন সংযোগমূলক উদ্যোগের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানে একজন খ্যাতনামা দানবীর ব্যক্তিত্ব ও তাঁর সহধর্মিণী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। নিজের প্রবাসজীবন ও কষ্টসাধ্য পরিশ্রমের গল্প শোনাতে গিয়ে তিনি বলেন, মানুষ জীবনে কিছুই সঙ্গে নিয়ে যায় না, কিন্তু মানবতার জন্য কাজ করলে সেই জীবন অর্থবহ হয়ে ওঠে। তাঁর বক্তব্যে আবেগাপ্লুত হয়ে দর্শকরা দাঁড়িয়ে সম্মান জানান।
এই পর্বে নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটির একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসকের ভিডিও বার্তা প্রদর্শিত হয়, যেখানে তিনি সংযোগের এই যাত্রাকে আরও সংগঠিত ও সুসংহত করার আহ্বান জানান। পরে নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের প্রথম বাংলাদেশি নারী কাউন্সিল সদস্য তাঁর কৈশোর থেকে মানুষের অধিকারের জন্য লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে ভবিষ্যতেও সক্রিয় থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
নিউ জার্সির একটি টাউনশিপের ডেপুটি মেয়র তাঁর বক্তব্যে বলেন, প্রবাসে জন্ম ও বেড়ে ওঠা হলেও তিনি নিজের শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই সবার জন্য কাজ করে যেতে চান। একই অঙ্গরাজ্যের আরেক টাউনশিপের নবনির্বাচিত কাউন্সিল সদস্য প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি আয়োজনে অংশ নিয়ে প্রবাসী থেকে জনপ্রতিনিধি হয়ে ওঠার গল্প শোনান। তাঁর সহকর্মী আরেক কাউন্সিল সদস্যও আমন্ত্রণের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটি গঠনে নীরবে কাজ করা এক নারী সমাজকর্মীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। তাঁর দীর্ঘদিনের নিঃস্বার্থ কর্মযজ্ঞের কথা শুনে উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হন। তিনি এই স্বীকৃতির জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান।
এছাড়া সম্পাদক, লেখক, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, পরিবেশ ও নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধি, কমিউনিটি নেতা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বক্তব্য দেন। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার লেখক ও সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের সক্রিয় উপস্থিতিও আয়োজনকে সমৃদ্ধ করে তোলে। সামগ্রিকভাবে এই কমিউনিটি সংযোগ অনুষ্ঠান প্রবাসে মানবিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করার একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।



