ব্রিটেনে শীতকাল মানেই যখন অন্য অনেক পেশার মানুষ উৎসব, ছুটি আর পারিবারিক সময় উপভোগ করেন, তখন ভিন্ন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হন শিক্ষকরা। অতিরিক্ত কাজের চাপ, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা আর মানসিক ক্লান্তি তাঁদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। অনেক শিক্ষক অসুস্থ শরীর ও অবসন্ন মানসিকতা নিয়েই নিয়মিত ক্লাসে দাঁড়াচ্ছেন। জনপ্রিয় ধারণা থাকলেও বাস্তবে স্কুল ছুটির সময়ও তাঁদের প্রকৃত বিশ্রাম খুব কমই জোটে।
ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের স্কুলগুলোতে শিক্ষকদের কর্মপরিবেশ যে ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে, তা নতুন করে আলোচনায় এসেছে ফোর ডে ইউক ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক আহ্বানে। সংস্থাটির মতে, শিক্ষকদের জন্য চার দিনের কর্মসপ্তাহ এখন আর কোনো বিলাসী দাবি নয়, বরং পেশাটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি জরুরি পদক্ষেপ। শিক্ষকদের ওপর কাজের চাপ এতটাই বেড়েছে যে প্রচলিত কাঠামোর ভেতরে থেকে তাঁদের সুস্থ ও কার্যকর রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।
ট্রেডস ইউনিয়ন কংগ্রেসের তথ্য এই সংকটকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। যুক্তরাজ্যে প্রতি দুইজন শিক্ষকের একজন সপ্তাহে গড়ে ২৬ ঘণ্টা বিনা পারিশ্রমিকে অতিরিক্ত কাজ করেন। অন্য কোনো পেশায় এত বেশি অবৈতনিক শ্রমের নজির নেই। এই অতিরিক্ত সময়ের হিসাব করলে বছরে একজন শিক্ষকের প্রকৃত আয়ের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার পাউন্ড কমে যায়। শিক্ষক সংগঠনের এক শীর্ষ নেতার ভাষায়, এটি দিনের আলোয় সংঘটিত আর্থিক ক্ষতির শামিল।
চার দিনের কর্মসপ্তাহের প্রয়োজনীয়তা এখানেই শেষ নয়। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা এখনো অনেকাংশে পুরোনো সময়ের কাঠামোতে আটকে আছে। শিক্ষকদের কাজ কেবল পাঠদানেই সীমাবদ্ধ নেই। শ্রেণিকক্ষের শৃঙ্খলা রক্ষা, শিক্ষার্থীদের মানসিক সহায়তা দেওয়া, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন এবং নানামুখী কাগজপত্রের কাজও তাঁদের কাঁধে এসে পড়ছে। এই অতিরিক্ত দায়িত্বের সরাসরি প্রভাব পড়ছে শিক্ষকসংকটের ওপর।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ থেকে ২৩ অর্থবছরে ইংল্যান্ডের স্কুলগুলো বদলি শিক্ষক নিয়োগে ব্যয় করেছে প্রায় ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন পাউন্ড। একই সঙ্গে ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র ৫৯ শতাংশ শিক্ষক জানিয়েছেন যে তিন বছর পরও তাঁরা এই পেশায় থাকার কথা ভাবছেন। মহামারির আগের সময়ের তুলনায় এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম। গত বছর ইংল্যান্ডে ৪১ হাজার ২০০ শিক্ষক পেশা ছেড়ে চলে গেছেন। এর ফলে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, যা সরাসরি শিক্ষার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
প্রস্তাবিত চার দিনের কর্মসপ্তাহের মডেলে স্কুল সপ্তাহে পাঁচ দিনই চালু থাকবে। তবে প্রত্যেক শিক্ষক সপ্তাহে একটি দিন পাবেন সংরক্ষিত সময় হিসেবে। এই সময়টি ব্যবহার করা হবে পাঠ পরিকল্পনা, মূল্যায়ন, প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত সহায়তার জন্য। এতে করে অভিভাবকদের জন্য শিশু দেখাশোনার বাড়তি চাপ তৈরি হবে না। অন্যদিকে শিক্ষকরা সন্ধ্যা কিংবা রাত পর্যন্ত কাজ করার বাধ্যবাধকতা থেকে কিছুটা মুক্তি পাবেন।
অবশ্য এই ব্যবস্থাও সব সমস্যার সমাধান নয়। সংকুচিত বাজেট, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং পরীক্ষানির্ভর কঠোর পাঠ্যক্রমের মতো বড় চ্যালেঞ্জ থেকেই যাবে। তবু ক্লান্ত ও অবসন্ন শিক্ষকদের কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে চার দিনের কর্মসপ্তাহ একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। শিক্ষা খাতের সংকট যখন শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং পুরো সমাজে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে, তখন এই প্রস্তাবকে আর সহজে অবহেলা করা যাচ্ছে না। বরং এটি এমন এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা শিক্ষাব্যবস্থার গভীর সংকটে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারে।



