Sunday, December 21, 2025
spot_img
Homeঅন্যান্যরক্তিম সাগর, রহস্যময় হরমুজ দ্বীপ

রক্তিম সাগর, রহস্যময় হরমুজ দ্বীপ

অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলে মাটিতে পড়া পানির রং মুহূর্তেই বদলে যায়। স্বচ্ছ জল ধীরে ধীরে টকটকে লাল হয়ে গড়িয়ে পড়ে সমুদ্রের দিকে। অল্প সময়ের মধ্যেই সাগরের বিস্তীর্ণ অংশ রক্তবর্ণ ধারণ করে। চোখের সামনে ভেসে ওঠা এই অদ্ভুত দৃশ্য কোনো কল্পকাহিনি নয়, বাস্তব। ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের হরমুজ দ্বীপে এমন দৃশ্য নিয়মিতই দেখা যায়। পারস্য সাগরের গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালিতে অবস্থিত এই দ্বীপ প্রকৃতির এক বিস্ময়কর রূপ তুলে ধরে।

প্রথম দেখায় অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এটি কি কোনো অলৌকিক ঘটনা, নাকি পরিবেশগত বিপর্যয়ের ইঙ্গিত। বাস্তবে বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। হরমুজ দ্বীপে বৃষ্টি হলেই প্রায় একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে। গত মঙ্গলবারও দ্বীপজুড়ে বৃষ্টিপাতের পর উপকূলীয় পানির রং লাল হয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখা গেছে। এর পেছনে রয়েছে দ্বীপটির বিশেষ ভূপ্রকৃতি ও মাটির গঠন।

স্থানীয় বাসিন্দারা দ্বীপের এই বিশেষ মাটিকে ‘গোলাক’ নামে চিহ্নিত করেন। এই মাটিতে লোহা বা আয়রন অক্সাইডের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। বৃষ্টির পানি মাটির সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে লোহার সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটে এবং পানির স্বাভাবিক রং পরিবর্তিত হয়ে লাল আভা ধারণ করে। বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করলে বলা যায়, পানির সঙ্গে মিশে থাকা লোহা আলোর স্বল্প তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে নেয়, আর দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত হয়। এই প্রতিফলিত আলোই মানুষের চোখে লাল রং হিসেবে ধরা পড়ে।

হরমুজ দ্বীপটি ইরানের রাজধানী থেকে প্রায় ৬৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে এখানে সারা বছর খুব বেশি বৃষ্টি হয় না। সাধারণত শীতকাল এবং বসন্তের শুরুতে স্বল্প সময়ের জন্য বৃষ্টিপাত হয়। এই অল্প সময়ের বৃষ্টিই দ্বীপের প্রকৃতিকে নতুন রূপে হাজির করে। অনেক পর্যটক এই বৃষ্টিকে ‘ব্লাড রেইন’ বা রক্তবৃষ্টি নামে অভিহিত করেন। তবে বাস্তবতা হলো, আকাশ থেকে নামা বৃষ্টির পানি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক থাকে। মাটিতে পড়ার পরই তার রং বদলায়।

দ্বীপটির মাটি কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণ নয়, ব্যবহারিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। হরমুজের মাটি স্থানীয় শিল্পকারখানায় এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতির কারণে এখানে শুধু লাল নয়, হলুদ, কমলা এবং আরও নানা রঙের মাটির স্তর দেখা যায়। এই বহুরঙা বৈশিষ্ট্যের কারণেই হরমুজ দ্বীপকে অনেকে ‘রংধনু দ্বীপ’ নামে ডাকেন।

এই রঙিন ভূপ্রকৃতি প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটককে আকৃষ্ট করে। প্রকৃতি ও ভূতত্ত্বে আগ্রহী মানুষদের কাছে হরমুজ দ্বীপ এক অনন্য গন্তব্য। সমুদ্র, পাহাড়, রঙিন মাটি আর বৃষ্টির সময়ের রক্তিম দৃশ্য একসঙ্গে মিলে দ্বীপটিকে করে তুলেছে ব্যতিক্রমী।

সাম্প্রতিক বৃষ্টির পর উপকূলের রক্তবর্ণ পানির ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, কেউ কেউ কৌতূহলী মন্তব্য করেছেন। একজন মন্তব্যে লিখেছেন, এমন দৃশ্য দেখেই হয়তো লোহিত সাগরের নামকরণের ধারণা জন্মেছিল। আরেকজন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যদি এই রঙের পেছনে বিরল খনিজের উপস্থিতি থাকে, তবে ভবিষ্যতে খনন কার্যক্রম দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করতে পারে।

প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট এই রক্তিম দৃশ্য হরমুজ দ্বীপকে বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। একই সঙ্গে এটি মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি নিজস্ব নিয়মেই কখনো কখনো এমন রূপ ধারণ করে, যা মানুষের কাছে বিস্ময়কর ও রহস্যময় মনে হলেও তার পেছনে লুকিয়ে থাকে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments