বিদায় নিচ্ছে ২০২৫। বছরটি ইতিহাসে জায়গা করে নিল যুদ্ধ, সংঘাত, গণআন্দোলন আর বৈশ্বিক অস্থিরতার এক অনন্য সময় হিসেবে। একদিকে বিভিন্ন অঞ্চলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, অন্যদিকে তরুণদের নেতৃত্বে অভূতপূর্ব গণবিক্ষোভ, পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় নতুন উত্তেজনা বিশ্ব রাজনীতিকে করেছে আরও জটিল। এই বছরটি দেখিয়েছে, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় শক্তির ভারসাম্য কত দ্রুত বদলে যেতে পারে এবং সাধারণ মানুষের অসন্তোষ কীভাবে বৈশ্বিক রূপ নিতে পারে।
২০২৫ সালে সবচেয়ে দৃশ্যমান ছিল জেনারেশন জেডের উত্থান। পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তে বসবাস করলেও এই প্রজন্মকে একসূত্রে বেঁধে দেয় বৈষম্য, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ। লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা, এশিয়া থেকে ইউরোপ, সর্বত্র রাজপথে নেমে আসে তরুণরা। তাদের প্রতিবাদের ভাষা ছিল আধুনিক, সংগঠন ছিল ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মনির্ভর এবং দাবিগুলো ছিল জীবনঘনিষ্ঠ। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকার ছিল তাদের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই আন্দোলনের সূচনা হয় সংসদ সদস্যদের সুযোগ সুবিধা নিয়ে বিতর্ক থেকে। দ্রুতই তা রূপ নেয় রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিস্তৃত প্রতিবাদে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও স্লোগান আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ এনে দেয়। আফ্রিকায় বিদ্যুৎ ও পানির সংকট ঘিরে তরুণদের ক্ষোভ রূপ নেয় রাজনৈতিক দাবিতে। লাতিন আমেরিকায় নিরাপত্তাহীনতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে। এসব আন্দোলন প্রমাণ করে, নতুন প্রজন্ম কেবল স্থানীয় নয়, বৈশ্বিক বাস্তবতাও গভীরভাবে অনুধাবন করছে।
একই সময়ে বিশ্ব রাজনীতি কাঁপিয়েছে একাধিক সামরিক সংঘাত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দুই প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত বিরোধ রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। ঐতিহাসিক স্থাপনার মালিকানা নিয়ে শুরু হওয়া এই সংঘাতে প্রাণ হারান বহু মানুষ, বাস্তুচ্যুত হন হাজারো বেসামরিক নাগরিক। আন্তর্জাতিক চাপ ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি হলেও উত্তেজনা পুরোপুরি কাটেনি।
দক্ষিণ এশিয়ায় বহু পুরোনো বিরোধ আবারও ভয়াবহ রূপ নেয়। সীমান্ত অঞ্চলে সশস্ত্র হামলার পর দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে কয়েক দিনের তীব্র লড়াই হয়। বিমান হামলা, ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ এবং ড্রোন ব্যবহারে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছালেও এই সংঘাত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে এবং বড় শক্তিগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের চিত্র আরও জটিল ছিল। একদিকে গাজায় দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় ধাপে ধাপে শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু হলেও অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য পুরো প্রক্রিয়াকে অনিশ্চিত করে রেখেছে। অন্যদিকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি সংঘাত বিশ্বকে নতুন করে আতঙ্কিত করে। পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় হামলা পাল্টা হামলায় মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে যুদ্ধের মেঘ ঘন হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি হলেও মূল বিরোধ অমীমাংসিতই থেকে গেছে।
আফ্রিকায় চলমান গৃহযুদ্ধ মানবিক বিপর্যয়ের চরম উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি দেশের সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াই তিন বছর ধরে দেশটিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। লাখো মানুষের মৃত্যু, কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতি এবং দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বিদেশি শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন এই যুদ্ধকে আরও দীর্ঘায়িত করেছে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
২০২৫ সালে আরেকটি আলোচিত বিষয় ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই নতুন মাত্রা পায়। উন্নত চিপ, শক্তিশালী এআই মডেল এবং রপ্তানি নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে নীতিগত টানাপোড়েন শুরু হয়। এই প্রতিযোগিতা কেবল প্রযুক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
বাণিজ্য ক্ষেত্রেও উত্তেজনা কম ছিল না। নতুন শুল্কনীতি ঘোষণার মাধ্যমে বড় অর্থনীতিগুলোর মধ্যে পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ বিশ্ববাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। আমদানি রপ্তানিতে চড়া শুল্ক আরোপ, নিষেধাজ্ঞা এবং তদন্ত বাণিজ্য ব্যবস্থাকে আরও অনিশ্চিত করে তোলে। এর প্রভাব পড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপরও।
সব মিলিয়ে ২০২৫ ছিল এক পরিবর্তনশীল ও অস্থির সময়। এই বছর দেখিয়েছে, যুদ্ধ ও শান্তি, প্রযুক্তি ও মানবিকতা, ক্ষমতা ও প্রতিবাদের দ্বন্দ্ব কীভাবে একই সঙ্গে বিশ্বকে নতুন পথে ঠেলে দিতে পারে। ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে, তা নির্ভর করবে এই অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্ব কতটা শিক্ষা নিতে পারে তার ওপরই।



