যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও ইউক্রেন ইস্যুতে সাম্প্রতিক অস্থিরতা ব্রিটেনের রাজনৈতিক দুর্বলতাকে নতুন করে উন্মোচন করেছে। হোয়াইট হাউসের চাপের মুখে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হন এবং শেষ পর্যন্ত কেবল টেকসই শান্তির আশাবাদ ব্যক্ত করেই থেমে যান। এই প্রতিক্রিয়া শুধু ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার পরিচায়ক নয়, বরং দীর্ঘকাল ধরে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়া ব্রিটিশ রাষ্ট্রযন্ত্রের অসাড় অবস্থাকেও প্রকাশ করে। এমন এক সময়, যখন বিশ্বব্যবস্থা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, ব্রিটেন এখনো পুরোনো ধারণা ও কৌশলের ওপর নির্ভর করে এগিয়ে চলেছে।
ডাউনিং স্ট্রিটে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এবং জার্মান চ্যান্সেলরের সঙ্গে বৈঠকেই এই সংকট সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইউরোপীয় নেতারা নিজেদের অবস্থান দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন, আমেরিকান প্রস্তাব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন এবং ইউক্রেনের নেতৃত্বও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ উভয়ের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু ব্রিটেন এমন কোনো অবস্থান তুলে ধরতে পারেনি, যা তাকে এই নতুন পোস্টআমেরিকান বাস্তবতায় একটি স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে পারে। বর্তমান নেতৃত্বের অধীনে দেশটির এমন কোনো প্রস্তুতিও দেখা যাচ্ছে না।
ব্রিটেনের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন সংকুচিত হওয়ার পেছনে যে আর্থিক কাঠামো বহুদিন ধরে দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে, সেটিই বড় ভূমিকা রাখছে। প্রধানমন্ত্রী একদিকে নৈতিক দায়িত্বের কথা বললেও অন্যদিকে ব্যয়সংকোচী নীতিতে অটল রয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে যে জাতীয় ঐক্যের ওপর জোর দেওয়া হয়, বাস্তবে সেই সমাজ আর একতাবদ্ধ নেই। অঞ্চলভেদে বিভাজন বেড়েছে এবং বহু দশকের বাজারনির্ভর নীতি সমাজকে দুর্বল করে তুলেছে।
দেশটির আর্থিকীকরণের প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের সার্বভৌম অবস্থানকে দুর্বল করেছে। অতিমূল্যায়িত মুদ্রা, ধ্বংসপ্রাপ্ত শিল্প এবং উৎপাদনের চেয়ে জল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে ব্রিটেনের পক্ষে ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দেওয়া, ইউরোপের নিরাপত্তা কাঠামোতে প্রভাব বিস্তার করা বা যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুত সমঝোতার চাপ মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী যে নীরব সমর্থনের পথে হাঁটছেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস যতটা না, তার চেয়ে বেশি বাধ্যবাধকতার ফল।
ব্রিটিশ রাষ্ট্র ঐতিহ্য একসময় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহসী ছিল, কিন্তু এখন সেটি অতিরিক্ত সতর্কতা ও ব্যবস্থাপনায় সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা থাকলেও তাদের মধ্যে দেশকে নতুনভাবে কল্পনা করার ক্ষমতা দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আধিপত্য আজও দেশের নীতিনির্ধারণে কঠোর সীমা নির্ধারণ করে দেয়। বহুদিন ধরে সমালোচনার মুখে থাকা সিভিল সার্ভিস দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর রাজনৈতিক দলগুলো বড় কোনো জাতীয় উদ্দেশ্য বহন না করে কেবল নির্বাচনী যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান নেতৃত্বের অবস্থান কোনো বিচ্যুতি নয়, বরং পুরো ব্যবস্থারই প্রতিফলন।
পুরোনো বিশেষ সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করে আজকের ব্রিটেনকে পুনর্গঠন সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন দেশের সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক অবস্থান পুনর্বিবেচনা। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তিনি এমন এক কাঠামোর ভেতরে আবদ্ধ যেটি নিজেই ক্ষয়ের দিকে ধাবিত। দুঃখজনক হলো শুধু নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা নয়, বরং এই রাষ্ট্রযন্ত্রও একই অক্ষমতার মধ্যে আটকে আছে। যতদিন ব্রিটেন অতীতের সফলতার স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারবে, ততদিন নেতৃত্ব পরিবর্তন হলেও মূল সংকট কাটবে না। দায়িত্বশীলতা থাকা সত্ত্বেও তারা দিকভ্রান্তই থেকে যাবে।



