দীর্ঘ কয়েক দশক পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফডিএ গনোরিয়া চিকিৎসায় নতুন দুটি অ্যান্টিবায়োটিক অনুমোদন দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে এলো, যখন যৌনবাহিত এই সংক্রমণটি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে এবং প্রচলিত ওষুধের বিরুদ্ধে জীবাণুর প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত বাড়ছে। দেশজুড়ে গনোরিয়ার সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় কার্যকর চিকিৎসা নিশ্চিত করা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।
এফডিএ জানায়, একটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক অনুমোদন পেয়েছে যা প্রাপ্তবয়স্ক ও কিশোর কিশোরীদের জন্য একবার খাওয়ার মুখে গ্রহণযোগ্য চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এটি বিশেষ দানাদার আকারে তৈরি, যা পানিতে গুলে খেতে হয়। অন্তত ১২ বছর বয়সী এবং নির্দিষ্ট ওজন পূরণকারী রোগীরা এই চিকিৎসা নিতে পারবেন। ওষুধটি তৈরি হয়েছে একটি অলাভজনক বৈশ্বিক গবেষণা অংশীদারত্ব এবং একটি বিশেষায়িত ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে।
এর পাশাপাশি, আরেকটি আন্তর্জাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে যে তাদের উদ্ভাবিত আরেকটি অ্যান্টিবায়োটিকও এফডিএর অনুমোদন পেয়েছে। এই ওষুধটি ট্যাবলেট আকারে দেওয়া হবে এবং ১২ বছর বা তার বেশি বয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে, বিশেষ করে যাদের জন্য বিকল্প চিকিৎসার সুযোগ সীমিত। চলতি বছরের শুরুতে একই ওষুধ নারীদের মূত্রনালির সংক্রমণ চিকিৎসার জন্যও অনুমোদন পেয়েছিল।
এফডিএর সংক্রামক রোগবিষয়ক দপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এক বিবৃতিতে বলেন, সহজ ধরনের গনোরিয়ার চিকিৎসায় এই অনুমোদনগুলো রোগীদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গনোরিয়ার কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি দ্রুত কমে আসছিল, কারণ সংক্রমণটির জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া ধীরে ধীরে বহু প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে।
গনোরিয়ার জীবাণু নিসেরিয়া গনোরিয়ি ইতোমধ্যে বহু পরিচিত ওষুধকে অকার্যকর করে তুলেছে। ফলে চিকিৎসকদের হাতে বিকল্প খুবই সীমিত হয়ে পড়েছিল। একটি বড় সমস্যা হলো, বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত মানক চিকিৎসায় ইনজেকশনের প্রয়োজন হয়, যার জন্য রোগীকে অবশ্যই ক্লিনিক বা চিকিৎসকের চেম্বারে যেতে হয়।
নতুন অনুমোদিত দুটি ওষুধই মুখে খাওয়ার, ফলে ইনজেকশন ছাড়াই চিকিৎসা সম্ভব হবে। এতে চিকিৎসা গ্রহণ অনেক সহজ হবে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে এক ডোজে সম্পূর্ণ চিকিৎসা শেষ করা যায় এমন ওষুধটি বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রয়োগ করা সহজ করবে এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা থাকা এলাকাতেও রোগীরা সুবিধা পাবেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গনোরিয়া ও অন্যান্য যৌনবাহিত সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ক্ল্যামাইডিয়া, গনোরিয়া ও সিফিলিসের রিপোর্টকৃত সংক্রমণ প্রায় ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু ২০২৩ সালেই ২৪ লাখের বেশি যৌনবাহিত সংক্রমণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।
চিকিৎসা না করলে গনোরিয়া গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এটি রক্তপ্রবাহ বা অস্থিসন্ধিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসাবিহীন গনোরিয়া প্রজনন অঙ্গের সংক্রমণ ঘটাতে পারে, যা বন্ধ্যত্ব ও গর্ভধারণজনিত জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। পুরুষদের ক্ষেত্রেও বিরল হলেও দীর্ঘমেয়াদে বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, গনোরিয়া প্রতিরোধে এখনো কোনো অনুমোদিত টিকা নেই।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত বা ভুল ব্যবহারও জীবাণুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অনেক সময় রোগীরা সম্পূর্ণ কোর্স শেষ না করায় জীবাণু টিকে যায় এবং ধীরে ধীরে ওষুধের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। নতুন একটি ওষুধ বিশেষভাবে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে এটি আগের অনেক অকার্যকর হয়ে পড়া ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী জীবাণুর ওপরও কাজ করতে পারে।
এই ওষুধটি কেবল গনোরিয়ার চিকিৎসার জন্যই ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর ফলে অন্য সংক্রমণে অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার কমবে এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির ঝুঁকিও তুলনামূলকভাবে কম থাকবে বলে গবেষকদের ধারণা।
সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এক ডোজে মুখে খাওয়ার এই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি বর্তমান মানক চিকিৎসার মতোই কার্যকর। ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত এই গবেষণায় ১২ বছর বা তার বেশি বয়সী ৯০০ এর বেশি রোগী অংশ নেন। ফলাফলে দেখা যায়, নতুন ওষুধ গ্রহণকারীদের নিরাময়ের হার প্রায় ৯১ শতাংশ, যা প্রচলিত চিকিৎসার সঙ্গে প্রায় সমান।
আরেকটি পৃথক গবেষণায় দ্বিতীয় ওষুধটির কার্যকারিতাও প্রমাণিত হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, এটি ব্যবহার করে নিরাময়ের হার মানক চিকিৎসার কাছাকাছি, যদিও কিছু ক্ষেত্রে হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, নতুন ওষুধ এলেও গনোরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই এখানেই শেষ নয়। ভবিষ্যতে জীবাণু আবারও প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করতে পারে, তাই আরও নতুন চিকিৎসা উদ্ভাবনের গবেষণা চালিয়ে যাওয়া জরুরি।



