যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বহু দক্ষিণ সুদানি নাগরিকের ভবিষ্যৎ আবারও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। সাময়িক সুরক্ষিত মর্যাদা বা টেম্পোরারি প্রোটেকটেড স্ট্যাটাসের মেয়াদ আগামী ৫ জানুয়ারি শেষ হওয়ার কথা থাকায় তাদের বড় একটি অংশকে সংকটাপন্ন নিজ দেশে ফিরে যেতে হতে পারে। মার্কিন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে শত শত মানুষ এমন একটি দেশে ফেরার মুখে পড়বেন, যেখানে দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, খাদ্যসংকট ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এখনো প্রকট।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী এক তরুণ ক্রীড়াবিদের জীবনকাহিনি এই উদ্বেগের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। তিনি বর্তমানে ভার্জিনিয়ায় থাকেন, একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড দলে খেলেছেন এবং মধ্যম দূরত্ব দৌড়ে অলিম্পিক ট্রায়ালে খেলার সম্ভাবনাও তৈরি করেছেন। তবে এই পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি দক্ষিণ সুদান থেকে আসা একজন অভিবাসী, যিনি টেম্পোরারি প্রোটেকটেড স্ট্যাটাসের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাস করছেন। এই সুরক্ষা উঠে গেলে তার মতো অনেকের জন্যই যুক্তরাষ্ট্রে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর থেকেই এটিই তার একমাত্র পরিচিত ঘর। শৈশবে নিজ দেশে সহিংসতা বাড়তে থাকায় পরিবার নিয়ে প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যেতে হয়। পরে ছাত্র ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে এসে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু টেম্পোরারি প্রোটেকটেড স্ট্যাটাস বাতিল হলে তাকে এমন এক দেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে, যেখানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ, নিরাপত্তাহীনতা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা বিদ্যমান। তার ভাষায়, সেখানে ফেরত পাঠানো মানে কার্যত জীবনের ঝুঁকি নেওয়া।
টেম্পোরারি প্রোটেকটেড স্ট্যাটাস মূলত সেইসব দেশের নাগরিকদের জন্য দেওয়া হয়, যেসব দেশকে সাময়িকভাবে বসবাসের অনুপযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দক্ষিণ সুদান ২০১১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই এই মর্যাদা পেয়ে আসছে। বছরের পর বছর মেয়াদ বাড়ানো হওয়ায় বহু দক্ষিণ সুদানি নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করেছেন, কর পরিশোধ করেছেন এবং স্থায়ী জীবন গড়ে তুলেছেন। অভিবাসন আইনজীবীদের মতে, অন্তত ১৪ বছর ধরে অনেক পরিবার এই মর্যাদার ওপর নির্ভর করে এখানে বসবাস করছে এবং মার্কিন অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে।
তবে বাস্তবতা হলো, দক্ষিণ সুদানের পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ। জাতিসংঘ বারবার সতর্ক করে জানিয়েছে, চলমান সংঘাত ও অর্থনৈতিক ভাঙনের কারণে লাখো মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সহিংসতা ও বাস্তুচ্যুতি এখনো থামেনি। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি দক্ষিণ সুদানকে ভ্রমণ ও প্রবেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা পরিস্থিতির গুরুতর দিকটি আরও স্পষ্ট করে।
যুক্তরাষ্ট্রের মেইন অঙ্গরাজ্যে দক্ষিণ সুদানি অভিবাসীদের একটি বড় অংশ বসবাস করছে। দীর্ঘদিন ধরে শ্রমশক্তির ঘাটতি পূরণে অভিবাসীদের আকর্ষণের চেষ্টা করছে রাজ্যটি। দক্ষিণ সুদান থেকে আসা মানুষরা সেখানে দোকান, গির্জা ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলেছেন এবং কমিউনিটি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। অনেকেই শরণার্থী হিসেবে এসে পরে নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তবে সবাই সেই সুযোগ পাননি।
অভিবাসন অধিকারকর্মীরা বলছেন, টেম্পোরারি প্রোটেকটেড স্ট্যাটাস মানুষকে সীমিত সময়ের জন্য কাজ ও বসবাসের অনুমতি দেয়, কিন্তু স্থায়ী নাগরিকত্বের কোনো পথ খুলে দেয় না। শরণার্থী মর্যাদা এক্ষেত্রে ভিন্ন, তবে সেই প্রক্রিয়াও এখন অত্যন্ত সীমিত। ফলে এই সুরক্ষা শেষ হলে বিকল্প আইনি পথ খুঁজে পাওয়া অধিকাংশের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।
ধর্মীয় ও সামাজিক নেতারাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, টেম্পোরারি প্রোটেকটেড স্ট্যাটাস শেষ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই কমিউনিটিতে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অনেকেই আইনি সহায়তা নেওয়ার সামর্থ্য পাচ্ছেন না। একই ধরনের প্রস্তুতি চলছে ওয়াশিংটন ডিসিসহ অন্যান্য শহরের দক্ষিণ সুদানি কমিউনিটিতেও, যেখানে জানুয়ারিতে সম্ভাব্য বহিষ্কারের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি দক্ষিণ সুদানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক কমিশন সতর্ক করেছে যে রাজনৈতিক দুর্নীতি ও সংকট সশস্ত্র সহিংসতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর দেশটিকে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ সতর্কতার তালিকায় রেখেছে এবং নাগরিকদের যেকোনো কারণে সেখানে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে টেম্পোরারি প্রোটেকটেড স্ট্যাটাসধারীদের সামনে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যাওয়ার কার্যকর বিকল্প খুবই সীমিত। আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন প্রক্রিয়া বছরের পর বছর ঝুলে থাকে এবং নতুন অভিবাসন কর্মসূচিগুলোও আগের মতো কার্যকর নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবু অনেকেই আশা ছাড়ছেন না। তাদের স্বপ্ন, যুক্তরাষ্ট্রেই নিরাপদ ও সম্মানজনক একটি জীবন গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিদিন ফিরে যাওয়ার ভয় নিয়ে বাঁচতে হবে না।



