জাপানের সঙ্গে চলমান কূটনৈতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে বড় পরিসরে সামরিক মহড়া শুরু করেছে চীন। বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাইওয়ানের স্বাধীনতামুখী তৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবার্তা দেওয়া এবং নিজেদের সামরিক সক্ষমতা যাচাই করাই এই মহড়ার প্রধান উদ্দেশ্য। সোমবার থেকে শুরু হওয়া এই সামরিক কার্যক্রমের নাম দেওয়া হয়েছে ‘জাস্ট মিশন ২০২৫’। এতে চীনের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং রকেট ফোর্স একযোগে অংশ নিচ্ছে।
চীনের ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড এক বিবৃতিতে জানায়, মহড়ার অংশ হিসেবে মঙ্গলবার সরাসরি গোলাবর্ষণের অনুশীলন চালানো হবে। এই অনুশীলনের জন্য তাইওয়ান ঘিরে পাঁচটি বিশেষ অঞ্চল নির্ধারণ করা হয়েছে। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে পরবর্তী দশ ঘণ্টা পর্যন্ত এসব অঞ্চলের আকাশ ও সমুদ্রসীমায় কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর থাকবে। ওই সময় বেসামরিক জাহাজ ও উড়োজাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
২০২২ সালে তৎকালীন মার্কিন স্পিকারের তাইওয়ান সফরের পর থেকে এটি তাইওয়ান ঘিরে চীনের ষষ্ঠ বড় ধরনের সামরিক মহড়া। সে সময় ওই সফরকে কেন্দ্র করে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল এবং এর ধারাবাহিকতায় চীন বারবার সামরিক মহড়ার মাধ্যমে শক্ত অবস্থান জানিয়ে আসছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জাপানের সরকারপ্রধানের এক কড়া বক্তব্য এই উত্তেজনাকে আরও উসকে দিয়েছে। তিনি ইঙ্গিত দেন, তাইওয়ানে যদি চীন সামরিক অভিযান চালায়, তাহলে টোকিও তার জবাব দিতে প্রস্তুত থাকবে। এই বক্তব্যের পরপরই তাইওয়ান ঘিরে চীনের নতুন সামরিক মহড়া শুরু হওয়ায় আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ আরও বেড়েছে।
ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, এই মহড়া তাইওয়ানের স্বাধীনতাকামী বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি এবং তাদের পেছনে থাকা বাইরের হস্তক্ষেপকারীদের জন্য একটি গুরুতর সতর্কবার্তা। তাঁর ভাষায়, সমুদ্র ও আকাশপথে যুদ্ধপ্রস্তুতির অনুশীলন, গুরুত্বপূর্ণ বন্দর অবরুদ্ধ করার সক্ষমতা যাচাই এবং বহুমুখী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলাই এই মহড়ার মূল লক্ষ্য।
মহড়াকে কেন্দ্র করে চীনের সামরিক বাহিনী একটি বিশেষ পোস্টারও প্রকাশ করেছে। ‘শিল্ডস অব জাস্টিস: স্ম্যাশিং ইলুশনস’ শিরোনামের ওই পোস্টারে দুটি সোনালি ঢাল, যুদ্ধজাহাজ এবং যুদ্ধবিমানের চিত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে চীন নিজেদের সামরিক শক্তি ও প্রস্তুতির বার্তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে চেয়েছে।
এদিকে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত এই মহড়া নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, এত বড় আকারের মহড়া তাইওয়ানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে।
এই মহড়ার মাধ্যমে চীন প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে যে, তাদের লক্ষ্য কেবল তাইওয়ান নয়, বরং বাইরের শক্তির সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপও প্রতিহত করা। এটি স্পষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের উদ্দেশে একটি বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের কাছে এক হাজার একশ দশ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রির ঘোষণা দেয়। রেকর্ড অঙ্কের এই অস্ত্র বিক্রির ঘোষণার মাত্র এগারো দিনের মাথায় চীনের এই বিশাল সামরিক মহড়া শুরু হলো। বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনাপ্রবাহ পূর্ব এশিয়ায় নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে এবং আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে।
সব মিলিয়ে, জাপানের সঙ্গে উত্তেজনা, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি এবং তাইওয়ান প্রশ্নকে কেন্দ্র করে চীনের এই সামরিক মহড়া এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।



