দক্ষিণ কোরিয়ার পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন সংগ্রহের উদ্যোগ নতুন ধাপে প্রবেশ করেছে, যা মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমর্থনের পর আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্বের অভাবের পর এবার সিউল যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন পেয়েছে, যা এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং পানির নিচের অস্ত্র প্রতিযোগিতার চিত্রকে পরিবর্তন করতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়া দীর্ঘদিন ধরেই পারমাণবিক সাবমেরিন পরিচালনায় অভিজাত দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হতে চাইছে, বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার সামরিক হুমকি মোকাবিলায়। দুই দেশের মধ্যে থাকা পারমাণবিক চুক্তির আওতায় জ্বালানি সরবরাহের অনুমোদন পাওয়ায় এই পথে একটি বড় বাধা সরিয়ে গেছে।
বিশ্লেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের মতে, দক্ষিণ কোরিয়ার এই দ্রুত অগ্রগতি চীনের অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে এবং জাপানকেও অনুরূপ সক্ষমতা গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সাবমেরিন ক্যাপ্টেন উল্লেখ করেছেন, পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন অত্যন্ত কার্যকর আক্রমণাত্মক ব্যবস্থা এবং এই অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা অনিবার্য।
সিউলের যুক্তি অনুযায়ী, সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার পানির নিচের হুমকি মোকাবিলায় এটি গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেশটি পুনরায় জোর দিয়ে বলেছে যে, তারা পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করবে না এবং পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধব্যবস্থাকে সম্মান করবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের পর এই চুক্তি একটি বড় অর্জন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, এটি দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা স্বায়ত্তশাসনকে আরও শক্তিশালী করবে।
উত্তর কোরিয়াও দাবি করেছে, তারা একই ধরনের সক্ষমতা উন্নয়ন করছে। মার্চ মাসে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশটির নেতা পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন পরিদর্শন করেছেন। তবে এই সক্ষমতা কতটা অগ্রসর, তা এখনো স্পষ্ট নয়। কিছু বিশ্লেষক ধারণা করছেন, পিয়ংইয়ং এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার সহায়তা পেতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
চীনের প্রভাব মোকাবিলায় দক্ষিণ কোরিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিন প্রকল্প যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন ডিজেলচালিত সাবমেরিনের তুলনায় দ্রুতগামী এবং অনেক সময় পানির নিচে থাকতে সক্ষম। এর ফলে উত্তর কোরিয়ার সাবমেরিন নজরদারিতে সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
জাপানও এই পরিস্থিতিতে তাদের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হতে পারে। টোকিওভিত্তিক নৌ-বিশেষজ্ঞদের মতে, জাপানের ছোট ডিজেলচালিত সাবমেরিন অগভীর পানিতে কার্যকর হলেও পারমাণবিক সাবমেরিন প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত কার্যক্রম সম্প্রসারণে সক্ষম হবে। এতে ভবিষ্যতে প্রতিশোধমূলক সক্ষমতার পথও তৈরি হতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জানান, দেশের পারমাণবিক সাবমেরিন প্রকল্প সম্পূর্ণভাবে প্রতিরক্ষামূলক এবং উত্তর কোরিয়াকে নিবৃত্ত করাই এর মূল উদ্দেশ্য। যদিও সব দেশ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাবে না, তবুও দেশটি নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে প্রস্তুত।
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সতর্ক করেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার এই প্রকল্প ‘পারমাণবিক ডোমিনো’ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ এক দেশের পারমাণবিক সামর্থ্য অর্জনের প্রতিক্রিয়ায় আশেপাশের দেশগুলোও একই পথে এগোতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া যৌথভাবে পারমাণবিক সাবমেরিন উন্নয়নে এগোতে পারে, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বর্তমানে কেবল যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, ভারত ও যুক্তরাজ্যের কাছেই পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া প্রথম ১৯৯৪ সালে এ ধরনের সক্ষমতা অর্জনের চিন্তা শুরু করেছিল, তবে কারিগরি জটিলতার কারণে অগ্রগতি সীমিত ছিল। পরবর্তীতে কিছু সীমিত সমর্থন পেলেও প্রকল্প পূর্ণরূপে এগোতে পারেনি।
বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও দক্ষিণ কোরিয়া স্বাধীনভাবে নকশা ও মৌলিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বর্তমানে রিয়্যাক্টর সংযোজন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। দেশটি আগামী দশ বছরের মধ্যে প্রথম পারমাণবিক সাবমেরিন নির্মাণ করতে পারে এবং অন্তত চারটি ৫ হাজার টন ক্ষমতার সাবমেরিন প্রয়োজন হবে।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, পারমাণবিক জ্বালানি সংগ্রহে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানান, এটি একটি অনুমোদন নয় বরং পরিবেশ তৈরি করার প্রক্রিয়া, যেখানে সব কেবল শেষ ধাপ ছিল জ্বালানি সংগ্রহ। এটি দক্ষিণ কোরিয়ার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।



