Sunday, December 21, 2025
spot_img
Homeসম্পাদকীয়ইউরোপে পপুলিজম ঠেকাতে নতুন অর্থনীতি

ইউরোপে পপুলিজম ঠেকাতে নতুন অর্থনীতি

ইউরোপের রাজনীতিতে এক নতুন ও অস্থির সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় জাতীয়তাবাদী ও জনতাবাদী শক্তির উত্থান শুধু রাজনৈতিক ভারসাম্যই নয়, ইউরোপের দীর্ঘদিনের সামাজিক কাঠামোকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, আয় ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগকে কেন্দ্র করে নতুন অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা।

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনের এক বছরের বেশি সময় পার হলেও বিরোধী শিবির এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের পরাজয়ের পূর্ণ বিশ্লেষণ প্রকাশ করতে পারেনি। তবে একটি প্রভাবশালী প্রগতিশীল সংগঠনের প্রকাশিত মূল্যায়নে বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারণায় গণতন্ত্রের ওপর হুমকির বিষয়টি অতিরিক্ত গুরুত্ব পেলেও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম, চাকরির নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল ভোটারদের প্রধান ভাবনা, যা প্রচারণায় পর্যাপ্ত গুরুত্ব পায়নি।

এই অভিজ্ঞতা ইউরোপের জন্যও বড় শিক্ষা। দশকের শেষ পর্যন্ত ইউরোপকে যে অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তার আভাস ইতোমধ্যেই স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নিরাপত্তা কৌশল নথিতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ইউরোপেও শিগগিরই তথাকথিত দেশপ্রেমিক দলগুলো সাফল্য পেতে পারে। ফ্রান্স ও জার্মানিকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় রাজনীতির মূল চালিকাশক্তিতে ইতোমধ্যেই ডানপন্থী দলগুলো জনসমর্থনে এগিয়ে রয়েছে, বিশেষ করে শ্রমজীবী ও নীলকলার কর্মীদের বড় একটি অংশ তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। অথচ মূলধারার দলগুলোর পক্ষ থেকে এই পরিবর্তনের উপযুক্ত ও দৃঢ় জবাব এখনো স্পষ্ট নয়।

ইউরোপ যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি, সেগুলো ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। ইউক্রেন যুদ্ধ, সবুজ রূপান্তরের গতি ধরে রাখা, জনসংখ্যাগত পরিবর্তন মোকাবিলা এবং বড় শক্তিগুলোর অর্থনৈতিক চাপ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা এর মধ্যে অন্যতম। একটি প্রভাবশালী গবেষণা সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, নতুন ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার যুগে ইউরোপকে প্রতিবছর অতিরিক্ত বিপুল পরিমাণ প্রতিরক্ষা ব্যয় বহন করতে হতে পারে। একই সঙ্গে ইউরোপের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়াতে অবকাঠামো ও জনকল্যাণমূলক খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথাও উঠে এসেছে।

এই ধরনের আর্থিক নীতির পরিবর্তন দীর্ঘদিন ধরে স্থবির হয়ে থাকা প্রবৃদ্ধিকে গতি দিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় পর্যায় ও জাতীয় উভয় স্তরেই রাজস্ব বৃদ্ধির প্রশ্নে প্রয়োজনীয় সাহসের ঘাটতি রয়েছে। কিছু দেশ যৌথ ঋণের ধারণার বিরোধিতা করছে এবং আগামী কয়েক বছরের বাজেট পরিকল্পনাও প্রত্যাশার তুলনায় দুর্বল। ফ্রান্সে অতিধনীদের ওপর সম্পদ কর আরোপের পক্ষে জনমত শক্ত হলেও সরকার বাজেট ঘাটতি কমানোর তাগিদ থাকা সত্ত্বেও সে পথে হাঁটতে অনিচ্ছুক।

এই অবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়বে কম আয়ের মানুষের ওপর। ব্যয় সংকোচন নীতি ও বৈষম্য বৃদ্ধির মাধ্যমে আর্থিক সমন্বয়ের বোঝা তাদেরই বহন করতে হবে। ফ্রান্স ও জার্মানিতে পেনশন সংস্কার ঘিরে সাম্প্রতিক তীব্র বিতর্ক ইউরোপের সামাজিক মডেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চলমান সংঘাতেরই প্রতিফলন। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ডানপন্থী দলগুলো কল্যাণ রাষ্ট্রকে জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত করে বিভাজনের রাজনীতি এগিয়ে নিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি বাস্তবে কতটা ফাঁপা হতে পারে। তবু শক্তিশালী বিকল্প প্রস্তাবের অভাবে সেই বার্তাই ভোটারদের কাছে কার্যকর হয়েছে। ইউরোপেও যদি অর্থনৈতিক নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন না আসে, তাহলে সামাজিক চুক্তি ভেঙে পড়ার ঝুঁকি বাড়বে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারগুলোর দায়িত্ব হবে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জনতাবাদী শক্তিকে বাড়তি সুযোগ না দেওয়া।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments