বিশ্বজুড়ে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণ ক্রমেই একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তৎকালীন মহাপরিচালক একসময় মন্তব্য করেছিলেন যে সহজ অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর আবিষ্কার ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। এই বক্তব্যের তাৎপর্য ছিল স্পষ্ট। যদি গবেষণা ও ব্যবস্থাপনায় নতুন পদ্ধতি গ্রহণ না করা হয়, তবে নতুন ওষুধ আবিষ্কার করা কিংবা বিদ্যমান কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক সংরক্ষণ করা দুটোই কঠিন হয়ে পড়বে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আশঙ্কাই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।
২০১৭ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী মাত্র ১৬টি অ্যান্টিবায়োটিক নিয়মিত ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে। এর বেশিরভাগই পুরোনো ওষুধের কাছাকাছি সংস্করণ, ফলে এগুলোর বিরুদ্ধেও দ্রুত প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি একটি দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। যেসব ওষুধ দীর্ঘমেয়াদি রোগে ব্যবহৃত হয়, সেগুলোর তুলনায় সংক্রমণ নিরাময়কারী ওষুধ ব্যবসায়িকভাবে কম লাভজনক। ফলে এই খাতে বিনিয়োগের আগ্রহও সীমিত। এ কারণে সামগ্রিক বৈজ্ঞানিক চিত্র এখনো হতাশাজনক।
তবু চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন পাওয়া গনোরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর দুটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আশার আলো দেখিয়েছে। এই অনুমোদন শুধু নতুন চিকিৎসার পথই খুলে দেয়নি, বরং গবেষণায় উৎসাহ জোগানোর একটি ভিন্ন মডেলের কার্যকারিতাও প্রমাণ করেছে। নতুন ওষুধগুলোর একটি উদ্ভাবিত হয়েছে একটি সুইস অলাভজনক গবেষণা সংস্থা এবং একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে। গবেষণা সংস্থাটি অর্থায়ন ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের দায়িত্ব নেয়, যাতে ব্যয় কমে এবং নিয়ন্ত্রক বাধা অতিক্রম করা সহজ হয়। শুরুতেই এমন সহায়তা থাকলে শিল্পখাতকে বৈশ্বিক প্রয়োজন অনুযায়ী গবেষণায় আগ্রহী করা সম্ভব হয়।
এই ধরনের অংশীদারত্ব এবং যুক্তরাজ্য সরকারের ২০২২ সালে চালু করা সাবস্ক্রিপশন মডেলকে বর্তমান ব্যবস্থার ভেতরে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক বাজারে আনার সবচেয়ে বাস্তবসম্মত উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। ওই মডেলে নির্দিষ্ট কিছু অ্যান্টিবায়োটিকে বিনিয়োগকারী কোম্পানিকে নির্দিষ্ট আয়ের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, যাতে গবেষণার ঝুঁকি কিছুটা কমে।
তবে বর্তমানে উন্নয়নাধীন ওষুধগুলোর উৎপাদন দ্রুত করলেও সমস্যার পুরো সমাধান হবে না। নতুন অনুমোদিত একটি অ্যান্টিবায়োটিককে অনেক সময় নতুন শ্রেণির ওষুধ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে, কারণ এটি ব্যাকটেরিয়ার এমন একটি অংশকে লক্ষ্য করে, যেখানে আগে কোনো ওষুধ কাজ করত না। তাত্ত্বিকভাবে এতে ব্যাকটেরিয়াকে নতুন করে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সময় লাগবে। চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা গনোরিয়ার জন্য নতুন বিকল্প পেয়ে স্বস্তি পেলেও সতর্ক করে দিচ্ছেন যে ভবিষ্যতে এই ওষুধের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ তৈরি হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
এ কারণেই নতুন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংরক্ষণমূলক নীতির কথা উঠছে। অনেকের মতে, এগুলো কেবলমাত্র মারাত্মক ও উচ্চমাত্রার প্রতিরোধী সংক্রমণের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা উচিত এবং যেখানে উন্নত পরীক্ষাগার সুবিধা রয়েছে, সেখানে সীমিতভাবে প্রয়োগ করা দরকার। এই ধরনের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার বিশ্বব্যাপী মানদণ্ড হওয়া প্রয়োজন হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তা বাস্তবায়ন করা কঠিন।
আরও বড় প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় অন্যান্য নতুন অ্যান্টিবায়োটিক কোথা থেকে আসবে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে ওষুধ খোঁজার প্রচেষ্টা, যেমন একসময় পেনিসিলিনের ক্ষেত্রে হয়েছিল, এখন আগের মতো ফলপ্রসূ নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে দ্রুত নতুন অণু শনাক্ত করার কথা বলা হচ্ছে, তবে ২০২০ সালে আলোচিত একটি সম্ভাবনাময় ওষুধ এখনো প্রাণীর ওপর পরীক্ষার পর্যায়েই আটকে আছে। পুরোপুরি বা আংশিকভাবে গবেষণাগারে তৈরি কৃত্রিম ওষুধও নিয়মিত উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু রসায়নের কঠোর বাস্তবতায় অনেক ধারণাই বাস্তবে রূপ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
বর্তমান বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন বলছে, অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে একই অবস্থানে থাকতে হলেও আমাদের খুব দ্রুত দৌড়াতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত ও সতর্ক ব্যবহারই কেবল আমাদের সীমিত সুবিধা ধরে রাখতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ভবিষ্যতের সাফল্য বিংশ শতাব্দীর বিপুল চিকিৎসা সাফল্যের তুলনায় অনেকটাই সীমিত বলে মনে হচ্ছে।



