বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ১৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে অস্ট্রেলিয়া। গত ১০ ডিসেম্বর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশটি একটি নতুন বৈশ্বিক বিতর্কের সূচনা করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা কিশোর-কিশোরীদের জীবনে বাস্তবিক পরিবর্তন আনবে কি না, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, দীর্ঘদিন ধরে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বেচ্ছানিয়ন্ত্রণের ওপর যে আস্থা রাখা হয়েছিল, তা আর যথেষ্ট মনে করা হচ্ছে না।
বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ ও চিন্তাবিদরা বহুদিন ধরেই বলে আসছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষতিকর প্রভাব ঠেকাতে আত্মনিয়ন্ত্রণ কার্যকর হয়নি। বিশেষ করে যখন এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক স্বার্থ নির্ভর করে ব্যবহারকারীদের যত বেশি সময় সম্ভব পর্দায় আটকে রাখার ওপর। দীর্ঘদিন ধরে এসব কোম্পানি কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে এসেছে। তারা প্রায়ই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার যুক্তি তুলে ধরে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ বা বয়সভিত্তিক সীমাবদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অস্ট্রেলিয়ার সরকার মনে করেছে, আর অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ফলে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই খাতে ন্যূনতম মানদণ্ড নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞা দেখিয়ে দিয়েছে যে কেবল নৈতিক যুক্তি দিয়ে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্বশীল করা সম্ভব হয়নি। বয়স যাচাইয়ের কার্যকর ব্যবস্থা, কিশোরদের জন্য নিরাপদ অ্যাকাউন্ট এবং প্রয়োজন অনুযায়ী অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করার মতো মৌলিক বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকেই কঠোর হতে হয়েছে। এই বাস্তবতা প্রমাণ করে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষেত্রে নৈতিক আহ্বান যথেষ্ট ছিল না, আইনি চাপ প্রয়োজন হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার পথ অনুসরণ করার বিষয়টি এখন বিবেচনায় নিচ্ছে মালয়েশিয়া, ডেনমার্ক ও ব্রাজিলের মতো দেশগুলো। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের মতো কিছু দেশ সরাসরি নিষেধাজ্ঞার পথে না গিয়ে আগে প্ল্যাটফর্মগুলোকে নিরাপদ করার চেষ্টা করতে চায়। এই কৌশল কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কিছু নকশাগত বৈশিষ্ট্য যেমন অনন্ত স্ক্রল, যা ব্যবহারকারীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি দিনের পর দিন ফোনে আটকে রাখে, কিংবা পরিবর্তনশীল পুরস্কার ব্যবস্থার মাধ্যমে জুয়ার মতো আচরণ তৈরি করা, সেগুলো ইতোমধ্যে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য কিশোরদের জন্য আসক্তিমূলক ফিড ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণের পরিকল্পনা করছে, যদি না অভিভাবকেরা বিশেষ অনুমতি দেন। তবে যুক্তরাজ্যে এখনো এ ধরনের কোনো সীমা কার্যকর হয়নি।
নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের সময় অস্ট্রেলিয়ায় অনেক তরুণ-তরুণী নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছে। এর মধ্যে একজন ১৫ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী কিশোর জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ হলে তিনি আরও বেশি একাকিত্বের শিকার হবেন। এ ধরনের বক্তব্য দেখিয়ে দেয়, এই সিদ্ধান্তের প্রভাব সবার ক্ষেত্রে একরকম হবে না। তাই যারা ভবিষ্যতে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা বিবেচনা করবে, তাদের উচিত কিশোরদের মতামত আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতা মাথায় রাখা। তবে শিশুদের একাকিত্বের আশঙ্কাকে অজুহাত বানিয়ে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার সুযোগ নেই। তরুণদের ক্ষোভের পেছনেও যুক্তি আছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই দ্রুত বিস্তার এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে নিয়ন্ত্রণের চেয়ে প্রযুক্তির অগ্রগতি অনেক এগিয়ে গেছে।
অস্ট্রেলিয়ার এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাভিত্তিক উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে সরাসরি কারণগত সম্পর্ক প্রমাণ করতে গবেষণাগুলো এখনো সংগ্রাম করছে। এই নিষেধাজ্ঞা সেই গবেষণার জন্য নতুন তথ্য যোগ করবে। সমালোচকেরা বলছেন, এই আইন তরুণদের নিয়ন্ত্রণহীন অনলাইন জগতে ঠেলে দিতে পারে বা তারা আইন এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল শিখে নেবে। যুক্তরাজ্যে অনলাইন সেফটি আইন কার্যকরের পর ভিপিএন ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ার ঘটনা এই আশঙ্কাকে কিছুটা জোরালো করে। তবে আচরণগত পরিবর্তন রাতারাতি আসে না। গতি নিয়ন্ত্রণ, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো বা ধূমপানের মতো ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, প্রথমে প্রতিরোধ থাকলেও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে।
অস্ট্রেলিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষেধাজ্ঞা এমন একটি ব্যবস্থায় সাময়িক বিরতি টেনেছে, যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এগোচ্ছিল। এটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে রাষ্ট্রগুলো আর অনির্দিষ্টকাল নিষ্ক্রিয় থাকবে না। অন্যান্য দেশেও অনলাইন নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করছে, নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকেও নিয়ন্ত্রণ আরোপে প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে সাড়া দেয়। কিন্তু যখন অনেক শিশু স্কুলের সমান সময় কাটাচ্ছে ফোনের পর্দায়, তখন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বুঝে নেওয়া উচিত যে অগ্রগতির অভাব সরকারগুলো গুরুত্বের সঙ্গেই দেখবে।



