নেপাল ভারতের পার্শ্ববর্তী তৃতীয় দেশ হিসেবে সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতনের মুখোমুখি হয়েছে। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন স্থানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধের প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে ২০ জনেরও বেশি মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে এবং দেশজুড়ে কারফিউ জারি রয়েছে। বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবনে হামলা চালানোর পাশাপাশি কয়েকজন রাজনীতিবিদের বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করেছে।
এই অস্থিরতার দৃশ্য অনেকের কাছে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে গত বছর বাংলাদেশের এবং ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার আন্দোলনের চিত্র। তবে ভারতের জন্য নেপালের গুরুত্ব ভিন্ন মাত্রার। প্রায় ১,৭৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ উন্মুক্ত সীমান্ত, ঐতিহাসিক ও কৌশলগত সম্পর্ক এবং জনগণের পারস্পরিক যোগাযোগ নেপালকে ভারতের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ পরিস্থিতি নিয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং নেপালের শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি জরুরি বৈঠকও আহ্বান করেন, যেখানে সীমান্তবর্তী অস্থিতিশীলতার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রীলঙ্কার আন্দোলনের মতো নেপালের ঘটনাতেও ভারত প্রস্তুত ছিল না। বিশেষ করে সরকারের প্রধানের পদত্যাগ দিল্লির নির্ধারিত সফরের ঠিক এক সপ্তাহ আগে হওয়ায় ভারতকে কূটনৈতিকভাবে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
নেপালের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির পাশেই রয়েছে চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড। শুধু তাই নয়, ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে প্রবেশের অন্যতম প্রধান রুটও নেপাল দিয়ে গেছে। ফলে এই অস্থিতিশীলতা ভারতের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতে বসবাসরত প্রায় ৩৫ লাখ নেপালি নাগরিক ও কর্মজীবীর জীবনযাত্রাতেও এ অশান্তির প্রভাব পড়তে পারে। উন্মুক্ত সীমান্তের কারণে দুই দেশের মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ পারিবারিক ও সামাজিক যোগাযোগ রয়েছে। একইসঙ্গে কয়েক দশকের পুরোনো চুক্তির আওতায় নেপালের ৩২ হাজার গুর্খা সেনা ভারতের সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করছে।
নেপাল ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। দেশটি ভারতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের জন্য। বার্ষিক দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া নেপালের ধর্মীয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে প্রতিবছর হাজার হাজার ভারতীয় ভক্ত যাত্রা করে থাকেন।
যদিও কাঠমান্ডুতে আপাতত সাময়িক শান্তি ফিরতে শুরু করেছে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন ভারতকে এখন কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত সতর্কভাবে এগোতে হবে। কারণ, নেপালের তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি ক্ষুব্ধ, এবং দেশটির প্রধান তিনটি বড় দল—কমিউনিস্ট পার্টি, নেপালি কংগ্রেস ও মাওবাদী কেন্দ্র—সবগুলোর সঙ্গেই ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
অন্যদিকে, নেপালে চীন ও ভারতের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করছে। সম্প্রতি সীমান্ত মানচিত্র নিয়ে দিল্লি ও কাঠমান্ডুর মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি লিপুলেখ পাসকে চীন-ভারত বাণিজ্য রুট হিসেবে ব্যবহারের বিরোধিতাও করেছে নেপাল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো নেপালের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে আস্থা পুনর্নির্মাণ। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়িয়ে এ ক্ষোভ প্রশমিত করা সম্ভব হতে পারে।
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) কার্যত অচল অবস্থায় থাকায় ভারতের জন্য প্রতিবেশী অস্থিরতার মোকাবিলা আরও কঠিন হয়ে উঠছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ইতিমধ্যেই তলানিতে, বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে টানাপোড়েন চলছে এবং মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য ভারতের আগে প্রয়োজন স্থিতিশীল ও নিরাপদ প্রতিবেশ, আর নেপালের এই সংকট আবারও সেই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে দিল্লিকে।