রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাটি আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছে—রাষ্ট্র যদি নাগরিকের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। একজন মানুষ যে মতাদর্শ বা পথের অনুসারীই হোন না কেন, তাঁর জীবন ও সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এই দায় ভুলে গেলে তার ফল কেমন ভয়ংকর হতে পারে, গোয়ালন্দের নৃশংস ঘটনাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
শরিয়তবিরোধী দাফনের অভিযোগ তুলে দরবার শরিফে হামলা, কবর থেকে মরদেহ উত্তোলন এবং তা পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা শুধু গুরুতর ফৌজদারি অপরাধই নয়, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধকেও গভীরভাবে আঘাত করেছে।
গত বছরের আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর থেকে ভিন্নমতের নাগরিকদের ওপর ধারাবাহিক সহিংসতার যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, গোয়ালন্দের এ ঘটনা তারই বেদনাদায়ক পরিণতি। শুক্রবার জুমার নামাজের পর একদল উন্মত্ত জনতা দরবার শরিফে হামলা চালায়। এসময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। হামলা ও সংঘর্ষে এক খাদেম নিহত হন এবং পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৫০ জন আহত হন। জনতা কয়েক দিন আগে মৃত্যুবরণ করা এক ব্যক্তির মরদেহ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেয়।
এই ভয়ংকর ঘটনার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিন্দা জানায় এবং অন্তর্বর্তী সরকারও এক বিবৃতিতে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। তবে বাস্তবে বিবৃতির ভাষার চেয়ে কার্যকর পদক্ষেপের অভাবই বেশি স্পষ্ট হয়েছে। কারণ, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজার, সুফি সমাধি ও দরগাহে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো পর্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ৪০টি মাজার, সমাধি ও দরগাহে হামলা হলেও গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র ২৩ জন। সহিংসতার তুলনায় এ পদক্ষেপ অত্যন্ত হতাশাজনক। গোয়ালন্দের ঘটনাতেও তিন দিন পেরিয়ে গেলেও ভুক্তভোগী পরিবার থেকে কোনো অভিযোগ দায়ের হয়নি। পুলিশ বাদী হয়ে তিন হাজার জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেছে এবং গ্রেপ্তার হয়েছে সাতজন। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের গয়রহ মামলা ন্যায়বিচারের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা এ ঘটনার পেছনে স্পষ্ট। কবর নিয়ে উত্তেজনা কয়েক দিন ধরে চললেও তা ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ দায় এড়ানো যায় না।
একটি সভ্য রাষ্ট্রে ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি ঘৃণা ও সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা এ ধরনের অপরাধে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসনের দায়িত্বশীল মহলকেও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সমাজে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়—এ সত্য কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি।