উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত ছোট্ট সার্ক দ্বীপে বসবাস করে ৫০০ জনেরও কম মানুষ। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত হলেও দ্বীপটির নিজস্ব সরকার পরিচালিত হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শান্ত পরিবেশ থাকলেও এখানকার মানুষের মন খুশি নয়, কারণ বিদ্যুতের দাম আকাশছোঁয়া পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সর্বশেষ দুই সপ্তাহে দ্বীপে এক কিলোওয়াট ঘণ্টার বিদ্যুতের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। বর্তমান খরচ প্রতি ইউনিট ১ দশমিক ১৩ ব্রিটিশ পাউন্ড, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৮৬ টাকা। তুলনামূলকভাবে ঢাকা শহরে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ৭ থেকে ১০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ দ্বীপটিতে বিদ্যুতের দাম বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ১৮ গুণ বেশি।
দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে সার্ক ইলেকট্রিসিটি লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ হলো সরকারের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ এবং সেই আইনি প্রক্রিয়ার ব্যয়ভার মোকাবিলা।
দ্বীপের স্থানীয় সরকার ‘চিফ প্লিয়াজ’ নামে পরিচিত। এটি গঠিত ১৮ জন নির্বাচিত সদস্য, ১ জন প্রেসিডেন্ট ও ১ জন উত্তরাধিকারী লর্ডের দ্বারা। এই সরকার চাইলে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে জোরপূর্বক ক্রয়ের জন্য আদালতে যেতে পারে।
অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা জানান, এই ছোট্ট দ্বীপে এমন উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ কখনও আশা করা যায়নি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিদ্যুতের দাম দেখা হয়েছে, তবে সার্ক দ্বীপের বর্তমান হার অত্যন্ত চমকপ্রদ।
মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। কম জনসংখ্যার কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মুনাফা সীমিত, এবং গত দুই দশকে দ্বীপে গ্রিডে বিনিয়োগ খুব কম হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন মূলত ডিজেল জেনারেটরের ওপর নির্ভরশীল। ডিজেল জ্বালানি প্রথমে পার্শ্ববর্তী দ্বীপ থেকে আনা হয়, যা খরচ বৃদ্ধি করে। এছাড়া প্রশাসনিক জটিলতাও বিদ্যুতের দামে প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা দ্বীপের বিদ্যুতের অবকাঠামোকে ঝুঁকিপূর্ণ ও জীবনকাল অতিক্রান্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
দ্বীপে বিদ্যুতের দাম নিয়ে উত্তেজনা নতুন নয়। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো এই বিষয়টি সরকারের আলোচনার বিষয় হয়। এরপর ছয় বছরের দর-কষাকষির পর সার্ক ইলেকট্রিসিটি প্রাইজ কন্ট্রোল কমিশনার নামের একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করা হয়। ২০১৮ সালে তারা প্রতি ইউনিটের দাম ৬৬ পেন্স নির্ধারণ করে। একই বছর বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটির মালিক হুমকি দেন, যে নির্ধারিত দাম ব্যয় মেটাতে যথেষ্ট নয়। পরে সরকার কোম্পানি ক্রয়ের প্রক্রিয়া শুরু করে, তবে সাত বছর ধরে এটি সম্পূর্ণ হয়নি।
বর্তমান মালিক এই ধীরগতির ক্রয়প্রক্রিয়ার কারণে নিজের আর্থিক ক্ষতি পূরণ করতে আইনি প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত খরচ যোগ করছেন। এটি বিদ্যুতের মূল্যের সর্বশেষ বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব দ্বীপের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডেও পড়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের খোলার সময় পরিবর্তন করছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি রেস্তোরাঁ তাদের বিদ্যুৎ বিল প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি হওয়ায় প্রতি সপ্তাহের খোলার সময় পুনঃপর্যালোচনা করছে।
বিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণ–বিষয়ক কমিশনার বলেন, বর্তমান দাম ন্যায্য বা যুক্তিসংগত নয় এবং অক্টোবরের আগে কোনো সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ সম্ভব নয়। সাধারণ অধিবাসীরাও উচ্চ মূল্যের বিদ্যুত প্রদান করতে অস্বীকার করছেন।
সম্প্রতি একটি গেস্ট হাউসের মালিক দ্বীপের বাসিন্দাদের নিয়ে সভা আয়োজন করেছেন, যেখানে তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সভায় উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে টিভি চালানোও সমস্যার মধ্যে পরিণত হয়েছে এবং দৈনন্দিন কাজগুলো করতে বারবার ভেবে নিতে হচ্ছে।
চিফ প্লিয়াজের পক্ষ থেকে একটি কমিটি নতুন নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর ভিত্তি করে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার নকশা করছে, যার ব্যয় হতে পারে ৮৬ লাখ পাউন্ড। একই সঙ্গে সরকার একটি আইন পাশ করেছে যা তাদের বাধ্যতামূলক ক্রয় করার অনুমতি দেয়। তবে আশা করা হচ্ছে, তা প্রয়োগের প্রয়োজন হবে না।
কমিটির কাউন্সেলর মন্তব্য করেছেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে কমিউনিটির সংবেদনশীল সদস্যদের ওপর চাপ ও ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও ক্রমশ ক্ষোভ বেড়ে চলছে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এত ব্যয়বহুল পরিস্থিতিতে কেন তারা দ্বীপে বসবাস বা বিনিয়োগ করবেন।