Monday, October 6, 2025
spot_img
Homeঅন্যান্যবিশ বছরে ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফ সূচনা, সসাফল্য ও ভবিষ্যতের রূপরেখা

বিশ বছরে ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফ সূচনা, সসাফল্য ও ভবিষ্যতের রূপরেখা

সূচনা ও পটভূমি:
বিশ্ব তথ্য সমাজ শীর্ষ সম্মেলন বা ডব্লিউএসআইএস (ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি) ছিল জাতিসংঘের একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। এর লক্ষ্য ছিল ডিজিটাল বিভাজন হ্রাস করা, তথ্যপ্রযুক্তির সুফল সর্বজনের জন্য নিশ্চিত করা এবং একযোগে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈশ্বিক তথ্য সমাজ গঠন। এই সম্মেলন দুটি ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমটি ২০০৩ সালে জেনেভায় এবং দ্বিতীয়টি ২০০৫ সালে তিউনিসে।

ডব্লিউএসআইএস সম্মেলনের অন্যতম দুটি মূল অর্জন হচ্ছে ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরাম (আইজিএফ) এবং ডব্লিউএসআইএস ফোরাম। আইজিএফ গঠিত হয় ডব্লিউএসআইএস ২০০৫-এর তিউনিস এজেন্ডার ভিত্তিতে। অপরদিকে ডব্লিউএসআইএস ফোরাম ২০০৬ থেকে ২০২৫ সালের প্রতিবছর ডব্লিউএসআইএস অ্যাকশন লাইনের অগ্রগতি পর্যালোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে জেনেভাতে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

ডব্লিউএসআইএস-এর অন্যতম প্রধান অর্জন ছিল ইন্টারনেট গভর্নেন্স বিষয়ে বৈশ্বিক আলোচনা শুরু করা এবং এর ভিত্তিতে ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরাম (আইজিএফ) প্রতিষ্ঠা। ২০০৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অনুরোধে গঠিত আইজিএফ এখন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ও গ্রহণযোগ্য বহুপক্ষীয় সংলাপভিত্তিক মঞ্চ। এখানে রাষ্ট্র, ব্যবসায়িক খাত, নাগরিক সমাজ, প্রযুক্তিবিদ, শিক্ষাবিদ ও তরুণ প্রতিনিধিরা একত্রিত হয়ে ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল নীতিমালা নিয়ে মুক্ত আলোচনা করেন।

ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফ-এর পদ্ধতি ও নীতি:
ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফ-এর মূল ভিত্তি হলো বহুপক্ষীয় অংশগ্রহণ। এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেয়ে আলোচনা, সমঝোতা ও নীতির প্রভাব তৈরির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আইজিএফ-এ কোনো বাধ্যতামূলক সিদ্ধান্ত হয় না, তবে এর আলোচনা ও প্রস্তাবনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণে প্রভাব রাখে।

অর্জনের ২০ বছর: ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফ-এর অবদান
বিশ বছর পেরিয়ে ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফ আজ একটি বৈশ্বিক ডিজিটাল সহযোগিতা ও ন্যায্যতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলো:

  • ডব্লিউএসআইএস-এর বহুপক্ষীয় মডেল এখন জাতিসংঘের অন্যান্য ডিজিটাল কাঠামোতেও প্রতিফলিত হচ্ছে।

  • আইজিএফ বর্তমানে ১৭০টিরও বেশি জাতীয়, আঞ্চলিক ও তরুণ নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ পরিচালনায় সহায়ক।

  • ঘঊঞসঁহফরধষ (২০১৪) ও ঘঊঞসঁহফরধষ+১০ (২০২৪) সম্মেলন নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার রূপরেখা প্রদান করেছে।

  • সাও পাওলো মাল্টিস্টেকহোল্ডার গাইডলাইনস নীতিগত সহনশীলতা ও সহযোগিতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তৈরি করেছে।

  • নারীদের অংশগ্রহণ, তরুণ নেতৃত্ব, এবং সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে।

আইএএনএ স্থানান্তর: ইন্টারনেট গভর্নেন্সের এক নতুন অধ্যায়
বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট যাতে সঠিকভাবে ও সুশৃঙ্খলভাবে চলে, তার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি দায়িত্ব থাকে। আইএএনএ-এর কাজগুলো না হলে ইন্টারনেটে যোগাযোগে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতো। এটি ইন্টারনেটের ‘ব্যাকএন্ড’ বা মূল কাঠামোর নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। আইএএনএ কাজ করছে আইপি ঠিকানা বরাদ্দ, ডোমেইন নেম সিস্টেম ব্যবস্থাপনা এবং ইন্টারনেট প্রোটোকল নাম্বার সমন্বয়ে।

ইন্টারনেট পরিচালনার ক্ষেত্রে আইএএনএ কার্যক্রমের স্থানান্তর ২০১৬ সালে ছিল এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপকে বলা হয় আইএএনএ ট্রানজিশন। ট্রানজিশনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয় বহুপক্ষীয় অংশগ্রহণমূলক মডেলের অধীনে। এটি ইন্টারনেট গভর্নেন্সের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, দায়িত্ববোধ এবং গ্লোবাল অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করেছে।

আইএএনএ স্থানান্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারনেট গভর্নেন্স ইস্যুগুলো নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা, পরামর্শ এবং কনসেনসাস গঠনে আইজিএফ বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে আইএএনএ ট্রানজিশন সরাসরি আইজিএফ-এর “আউটকাম” না হলেও, এটি বহুপক্ষীয় মডেলের সাফল্যের একটি বাস্তব উদাহরণ।

ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফ-এর অপূর্ণতা ও চ্যালেঞ্জ
যদিও ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি করেছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে:

  • আজও অনেক দেশে শহর ও গ্রামের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন বিদ্যমান। ইন্টারনেট সুবিধা, ডিভাইস ও ডিজিটাল সাক্ষরতায় সমতা নেই।

  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাবে নতুন নীতিগত জটিলতা তৈরি হয়েছে, যার জন্য এখনও উপযুক্ত আন্তর্জাতিক কাঠামো অনুপস্থিত।

  • মিসইনফরমেশন, ডিসইনফরমেশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ফেক নিউজ বৈশ্বিক আস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

  • আইজিএফ-এর আলোচনার ফলাফল অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া আইজিএফ-এ সরাসরি প্রতিফলিত হয় না।

ডব্লিউএসআইএস+২০ ও ভবিষ্যতের রূপরেখা:
২০২৫ সালে ডব্লিউএসআইএস-এর ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ডব্লিউএসআইএস+২০ পর্যালোচনা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে একটি উচ্চ পর্যায়ের আন্তঃসরকার বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ৮০তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধীনে প্রস্তুতিমূলক সভা ও পরামর্শ কার্যক্রম চলছে।

এই পর্যালোচনায় আইজিএফ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে—যেখানে বহুপক্ষীয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাস্তব অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তাবনা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বহু দেশ আইজিএফ-এর ম্যান্ডেট স্থায়ী করার পক্ষে মত দিয়েছে।

বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরামের ভূমিকা:
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরাম (বিআইজিএফ), ইউএন আইজিএফ-এর সঙ্গে সংযুক্ত একটি নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় প্ল্যাটফর্ম। এর লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে ডিজিটাল নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ তৈরি করা এবং সরকারের সঙ্গে সমন্বিতভাবে ইন্টারনেট গভর্নেন্স কাঠামো গড়ে তোলা।

বিআইজিএফ-এর উল্লেখযোগ্য অর্জনসমূহ:

  • ডট বাংলা (.বাংলা) টপ-লেভেল ডোমেইনের স্বীকৃতির জন্য নীতি প্রণয়ন ও অ্যাডভোকেসি।

  • সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলা, যেমন খএজ ও ঘইএচ।

  • বিটিআরসি-এর সদস্যপদ ও আন্তর্জাতিক আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ।

  • ইউনিভার্সাল অ্যাকসেপ্টেন্স প্রমোট করে বাংলা ভাষার ইমেইল ও ডোমেইন অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা।

  • বাংলাদেশ স্কুল অফ ইন্টারনেট গভর্নেন্স, ইয়ুথ আইজিএফ, ওমেন আইজিএফ, কিডস আইজিএফ-এর মাধ্যমে তরুণ, নারী ও শিশুদের যুক্তকরণ।

  • জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ডব্লিউএসআইএস ও জাতিসংঘের বৈশ্বিক ডিজিটাল চুক্তি বিষয়ে কার্যকর সংলাপ ও কনসালটেশন।

  • বিআইজিএফ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, এটুআই এবং ইন্টারনেট সোসাইটি বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে, যা নীতিগত অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

উপসংহার:
ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফ-এর ২০ বছর আমাদের দেখিয়েছে, কীভাবে একটি অংশগ্রহণমূলক, মানবকেন্দ্রিক ও ন্যায্য ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলা যায়। তবে চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান—ডিজিটাল বিভাজন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নীতিগত সংকট এবং তথ্যের অপব্যবহার।

ডব্লিউএসআইএস+২০ পর্যালোচনা ও জাতিসংঘের ডিসেম্বর ২০২৫ বৈঠক একটি নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে—যেখানে এই ফোরামগুলোর কার্যকারিতা, অংশগ্রহণ এবং নীতিগত প্রতিফলন আরও দৃঢ় করা যেতে পারে। আশা করা যায়, ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফ ভবিষ্যতেও ডিজিটাল ন্যায়বিচার, অন্তর্ভুক্তি ও মানবাধিকারের পক্ষে একটি শক্তিশালী বিশ্বমঞ্চ হিসেবে কাজ করবে, এবং বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক অগ্রযাত্রায় তার ভূমিকা আরও জোরদার করবে।

মোহাম্মদ আব্দুল হক অনু
মহাসচিব, বাংলাদেশ ইন্টারনেট
গভর্নেন্স ফোরাম

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments