বিদায়ী ২০২৫ সালের জুন মাসকে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ইতিহাসে আর সাধারণ সময় হিসেবে দেখা হচ্ছে না। ওই মাসের মাঝামাঝি, ১৩ জুন প্রথমবারের মতো ইরান ও ইসরায়েল একে অপরের ভূখণ্ডে সরাসরি, প্রকাশ্য ও পূর্ণমাত্রার সামরিক আঘাত হানে। এতদিন যে দ্বন্দ্ব ছিল ছায়ার আড়ালে, প্রক্সি শক্তির মাধ্যমে কিংবা কৌশলগত অস্বীকারের ভেতরে সীমাবদ্ধ, তা হঠাৎ করেই প্রকাশ্য সংঘাতে রূপ নেয়। মাত্র ১২ দিনের এই লড়াই কোনো দেশের ভূখণ্ড দখল বা সরকার পতনের দিকে না গেলেও মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ধারণা, আগাম হামলার নৈতিকতা এবং আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয়।
সংঘাত শুরুর আগের কয়েক মাস ধরেই ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক ছিল চরম উত্তেজনাপূর্ণ। গাজা যুদ্ধের প্রভাব তখনো পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিল। লেবানন সীমান্তে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের নিয়মিত গোলাবিনিময়, সিরিয়ায় ইরান–সমর্থিত লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের বিমান হামলা মিলিয়ে একটি নিয়ন্ত্রিত অস্থিরতা চলছিল। প্রকাশ্য যুদ্ধ এড়িয়ে চললেও দুই পক্ষই একে অপরের শক্তি ও সীমা যাচাই করছিল।
১৩ জুন ভোররাতে সেই অস্থিরতা হঠাৎই বিস্ফোরণে রূপ নেয়। ইরানের বিভিন্ন শহরের আকাশে ড্রোনের শব্দ ও বিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হয় সমন্বিত হামলা। ইসরায়েল এ অভিযানের নাম দেয় ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। লক্ষ্য ছিল ইরানের সংবেদনশীল পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি, গবেষণাগার এবং শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের আবাসন। আঘাত ছিল দ্রুত ও নিখুঁত। ইসরায়েলি নেতৃত্বের ভাষ্য অনুযায়ী, এটি ছিল আগাম আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ। তাদের দাবি, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।
তবে এ যুক্তি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে। আন্তর্জাতিক পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব গোয়েন্দা মূল্যায়ন ইঙ্গিত দেয়, ইরান তখনো অস্ত্র তৈরির পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ফলে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য হুমকি কি আগাম হামলার বৈধতা দিতে পারে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনি ও নৈতিক বিতর্ক শুরু হয়।
ইসরায়েলি হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্পষ্ট হয়, তেহরান নীরব থাকবে না। দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে জানানো হয়, হামলার জবাব দেওয়া হবে। পররাষ্ট্র দপ্তর ঘোষণা করে, ইরান আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করবে। এরপরই ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা শুরু হয় ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে। তেল আবিব ও হাইফা এলাকায় সতর্কতা সাইরেন বেজে ওঠে, মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যায়। এ পাল্টা আঘাতে ইসরায়েলে ২৮ জন নিহত হন এবং তেল শোধনাগার, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সামরিক অবকাঠামোর কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই পাল্টাপাল্টি হামলা দ্রুত ১২ দিনের এক নিয়ন্ত্রিত সংঘাতে রূপ নেয়। কোনো পক্ষই সর্বশক্তি প্রয়োগ করেনি, কিন্তু প্রতিদিনই উত্তেজনা ছিল চরমে। ইরানে নিহত হন অন্তত ৯৭৪ জন, যাদের মধ্যে সামরিক বাহিনীর সদস্য, বিজ্ঞানী ও বেসামরিক নাগরিকও ছিলেন। হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। ইসরায়েলেও ক্ষয়ক্ষতি ছিল উল্লেখযোগ্য। দেশটির ভেতরে অনেকে স্বীকার করেন, এই ১২ দিনে হওয়া ক্ষতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হামাস বা হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘর্ষের মোট ক্ষতির চেয়েও বেশি ছিল।
সংঘাত দেখিয়ে দেয়, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের যুগে ভৌগোলিক দূরত্ব আর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নয়। ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। নাথাঞ্জ ও ফোরদোতে আঘাতে অবকাঠামোগত ক্ষতি হলেও কর্মসূচি পুরোপুরি স্থবির হয়নি। বরং বিশেষজ্ঞদের মতে, এ হামলা ইরানকে আরও গোপন ও শক্তিশালী নিরাপত্তাব্যবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও সামরিক সাফল্য সীমিত ছিল। বিমান হামলা প্রভাব ফেললেও ইরানের ভূগর্ভস্থ স্থাপনা ও মানবসম্পদ পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। ফলে সামরিক অর্জনের তুলনায় রাজনৈতিক ও কৌশলগত লাভ ছিল কম। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক ও সামরিকভাবে সংঘাতে জড়ায়। ওয়াশিংটন ইসরায়েলের নিরাপত্তার পক্ষে অবস্থান নিলেও সরাসরি অংশগ্রহণ তেহরানের অবস্থানকে আরও কঠোর করে তোলে।
এই সংঘাত আঞ্চলিক শক্তিগুলোকেও সতর্ক করে তোলে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক ও কাতার প্রকাশ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার আহ্বান জানালেও নিজেদের নিরাপত্তা প্রস্তুতি জোরদার রাখে। কারও সরাসরি অংশগ্রহণ না থাকায় সংঘাত বিস্তৃত যুদ্ধের দিকে যায়নি, তবে কূটনৈতিক চাপ ও মধ্যস্থতা চলেছে জোরেশোরে।
১২ দিনের এই যুদ্ধ শেষ হলেও এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। মানবিক ক্ষতি, অবকাঠামোগত ধ্বংস এবং মানসিক চাপ দুই দেশেই গভীর ছাপ ফেলেছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন, আগাম হামলার বৈধতা এবং নৈতিকতার প্রশ্ন আরও জটিল হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্য নতুন করে হিসাব করতে বাধ্য করেছে এবং আগামী বছরগুলোতে এর প্রভাব স্পষ্টভাবেই টের পাওয়া যাবে।



