মেধাস্বত্ব চুরির অভিযোগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতের প্রভাবশালী ছয়টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত এক অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও আরও পাঁচজন লেখক। এই মামলাকে এআই শিল্পে কপিরাইট ও নৈতিকতা নিয়ে চলমান বিতর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক একটি রক্ত পরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভয়াবহ জালিয়াতি উন্মোচনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিচিতি পাওয়া নিউইয়র্ক টাইমসের ওই সাংবাদিক এবার প্রযুক্তি জায়ান্টদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে নামলেন। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আরও পাঁচজন লেখক। তাঁদের অভিযোগ, অনুমতি ছাড়াই তাঁদের লেখা বই ব্যবহার করে চ্যাটবট প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যা সরাসরি মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনের শামিল।
গত সোমবার ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ফেডারেল আদালতে যৌথভাবে মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলায় বিবাদী হিসেবে নাম রয়েছে গুগল, মেটা, ওপেনএআই, এক্সএআই, অ্যানথ্রোপিক এবং পারপ্লেক্সিটির মতো শীর্ষস্থানীয় এআই প্রতিষ্ঠানের। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান লেখকদের কোনো সম্মতি বা লাইসেন্স ছাড়াই তাঁদের বই সংগ্রহ করেছে এবং সেগুলো লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের প্রশিক্ষণে ব্যবহার করেছে।
মামলার নথিতে উল্লেখ করা হয়, লেখকদের সৃজনশীল কাজগুলো সরাসরি ইনপুট হিসেবে ব্যবহার করে চ্যাটবট তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক সুবিধা অর্জন করছে। লেখকদের দাবি, এটি শুধু কপিরাইট আইন লঙ্ঘন নয়, বরং লেখক সমাজের পেশাগত অধিকার ও আর্থিক নিরাপত্তার ওপর গুরুতর আঘাত।
বাদীপক্ষের মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়নের নামে যেভাবে বিপুল পরিমাণ কনটেন্ট সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেখানে সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের অধিকার প্রায় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। তাঁরা বলেন, বই লেখার পেছনে বছরের পর বছর শ্রম, গবেষণা ও অভিজ্ঞতা জড়িত থাকে। সেই কাজগুলো বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হলে তা ন্যায্যতা ও আইনের পরিপন্থী।
এই মামলাটি আরও একটি কারণে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। এর আগে বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলেও, এবারই প্রথম ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠিত এক্সএআইয়ের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা হলো। ফলে এটি এআই শিল্পে আইনি নজির তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
মামলায় বাদীপক্ষের আইনি প্রতিনিধিত্ব করছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বনামধন্য আইন প্রতিষ্ঠান। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আদালতের মাধ্যমে তারা স্পষ্ট করতে চান যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রেও প্রচলিত কপিরাইট আইন প্রযোজ্য এবং সৃষ্টিশীল কাজের সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
অন্যদিকে, মামলার বিষয়ে এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত কোনো এআই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান দাবি করে আসছে, এআই প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত তথ্য জনস্বার্থ ও গবেষণার আওতায় পড়ে। এই যুক্তি আদালতে কতটা টিকবে, তা নিয়েই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মামলার রায় ভবিষ্যতে এআই শিল্পের জন্য দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করতে পারে। যদি লেখকদের পক্ষে রায় আসে, তাহলে এআই মডেল প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং ও অনুমতির বাধ্যবাধকতা আরও কঠোর হতে পারে। আর যদি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে রায় যায়, তাহলে কপিরাইট আইন নতুন করে পর্যালোচনার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।
সব মিলিয়ে, এই মামলা কেবল কয়েকজন লেখকের ব্যক্তিগত লড়াই নয়। এটি সৃষ্টিশীলতা, প্রযুক্তি এবং আইনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার একটি বড় পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।



