যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বর্তমান প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ করে বলেছেন, কঠোর অবস্থানে না গিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোই তাঁর জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের সিদ্ধান্ত হবে। সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় নিজের বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এই মন্তব্য করেন। ওয়াশিংটন ও কারাকাসের মধ্যকার চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের বক্তব্য নতুন করে আন্তর্জাতিক আলোচনায় বিষয়টি সামনে এনেছে।
লাতিন আমেরিকার তেলসমৃদ্ধ দেশ ভেনেজুয়েলার ওপর চাপ বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক তৎপরতা জোরদার করেছে। ক্যারিবীয় সাগর ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ওয়াশিংটনের দাবি, এই তৎপরতার উদ্দেশ্য মাদক পাচার দমন। তবে এসব অভিযানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেন, ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট কী সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটি তাঁর নিজের ব্যাপার। তবে তাঁর মতে, ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোই হবে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ। তিনি আরও বলেন, যদি ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট কঠোর অবস্থান নিতে চান, তবে সেটিই তাঁর শেষবারের মতো কঠোর অবস্থান নেওয়া হতে পারে। এই মন্তব্যকে অনেকেই সরাসরি হুমকির সুর হিসেবে দেখছেন।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট টানা ১২ বছর ধরে দেশটির ক্ষমতায় রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে আসছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী মাদক পাচারের অভিযোগে একাধিক নৌযানের ওপর হামলা চালিয়েছে। এসব অভিযানে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে ভেনেজুয়েলা সরকার এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন জেলে ছিলেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এর প্রতিক্রিয়া জানান ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের উচিত কারাকাসকে হুমকি না দিয়ে নিজের দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়া। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো সঠিকভাবে সামাল দিতে পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।
এই পরিস্থিতিতে ভেনেজুয়েলার প্রধান মিত্র রাশিয়া প্রকাশ্যে দেশটির সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হয়েছে। ওই আলাপে মাদক দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্রের নৌযান হামলা, তেল ট্যাংকার জব্দসহ সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের কঠোর নিন্দা জানানো হয়।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, ক্যারিবীয় সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি ওই অঞ্চলের জন্য গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে এবং আন্তর্জাতিক নৌপরিবহন ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। একই সঙ্গে ভেনেজুয়েলার নেতৃত্ব ও জনগণের প্রতি রাশিয়ার পূর্ণ সমর্থন এবং সংহতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলায় সব ধরনের তেল ট্যাংকার যাতায়াত নিষিদ্ধ করে। পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যাতায়াতকারী ট্যাংকারগুলোকে আটকানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দাবি, ভেনেজুয়েলার সরকার তেল বিক্রির অর্থ দিয়ে মাদক সন্ত্রাস, মানবপাচার, হত্যা ও অপহরণের মতো কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করছে। তিনি আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা যুক্তরাষ্ট্রের তেল নিয়ে যাচ্ছে এবং সেই তেল ফেরত চায় ওয়াশিংটন।
অন্যদিকে, কারাকাসের আশঙ্কা যুক্তরাষ্ট্র দেশটিতে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। এ কারণে ভেনেজুয়েলা ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জলদস্যুতার অভিযোগও এনেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও বিষয়টি নিয়ে আইনি জটিলতা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন ডিস্ট্রিক্ট জজ সে দেশ থেকে বিতাড়িত ভেনেজুয়েলার ১৩৭ নাগরিককে ফেরত আনার নির্দেশ দিয়েছেন। মাদক পাচার ও অপরাধচক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে তাদের এল সালভাদরে পাঠানো হয়েছিল এবং তারা বর্তমানে সেখানে কারাবন্দী রয়েছেন। আদালতের মতে, তাদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই বিতাড়ন করা হয়েছে। বিচারক দুই সপ্তাহের মধ্যে তাদের ফেরত আনার একটি পরিকল্পনা জমা দিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন।
সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে উত্তেজনা আরও গভীর হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন করে চাপ তৈরি করছে।



