পাখি শিকার বন্ধের দাবি বহু পুরোনো হলেও বাস্তবে এর তীব্রতা কমেনি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই অনৈতিক কার্যক্রম নতুন নতুন রূপে ফিরে আসছে। প্রায় তিন দশক আগের একটি অভিজ্ঞতা আজও সেই বাস্তবতার সাক্ষ্য দেয়। এক শীতের ভোরে ঢাকা থেকে খুলনায় পৌঁছে রূপসা ফেরিঘাটের ব্যস্ততা পেরিয়ে ফকিরহাটের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেখানে পৌঁছে এক পক্ষিবিদের আমন্ত্রণে হাওর ও বিল এলাকা ঘুরতে গিয়ে চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ জলাভূমির ওপর পাতা জাল। প্রথমে সেটিকে মাছ ধরার জাল মনে হলেও পরে জানা যায়, এগুলো মূলত শীতকালীন পাখি ধরার জন্য ব্যবহৃত কারেন্ট জাল, স্থানীয়ভাবে যা ‘গগা’ নামে পরিচিত। এই জালের মাধ্যমে একসঙ্গে শত শত পাখি আটকানো হয় এবং সেগুলো বাজারে বিক্রি করা হয়। কোনো কোনো গ্রামে প্রায় পুরো জনগোষ্ঠীই এই কাজে যুক্ত ছিল।
সেই সময় বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার নিষিদ্ধ থাকলেও জালের মাধ্যমে নির্বিচারে পাখি ধরার প্রবণতা ছিল ভয়াবহ। সময়ের ব্যবধানে কিছু এলাকায় এই পদ্ধতির ব্যবহার কমলেও সার্বিকভাবে পাখি শিকার বন্ধ হয়নি। বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিকার যেন নতুন করে বেড়ে উঠেছে। প্রায় তিন দশক আগে দেশে পাখি পর্যবেক্ষক ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন। বর্তমানে সেই সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়েছে। একই সঙ্গে সচেতন মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে লক্ষাধিক। তবু এই সচেতনতা শিকার কমাতে পারছে না, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
পরিযায়ী হাঁস, বক, পানকৌড়ি, শালিকসহ নানা প্রজাতির পাখি আজ নিরাপত্তাহীন। রাজধানী ঢাকায়ও পাখিরা যেখানে রক্ষা পাচ্ছে না, সেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ঘুঘু, কোড়া, কালেম, ডাহুক ও বকের মতো দেশি পাখি সারা বছর ধরেই শিকারের শিকার হচ্ছে। শীত মৌসুমে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিষটোপ ব্যবহার করে পরিযায়ী হাঁস ও জলচর পাখি নিধন। সিলেট, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাজীপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় সব অঞ্চলে শিকারিদের দৌরাত্ম্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিশেষ করে শীত এলে কিছু এলাকায় রেস্টুরেন্টগুলোতে পরিযায়ী পাখির মাংস পরিবেশন বাড়ে। বিষটোপে মারা পাখির মাংস খেয়ে মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন হাওর এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে বন্দুক, বিষটোপ ও জালের মাধ্যমে ব্যাপক শিকারের তথ্য পাওয়া গেছে। স্থানীয় পাখিপ্রেমী ও পরিবেশসচেতন মানুষেরা বন বিভাগ ও প্রশাসনের সহায়তায় শিকার বন্ধের চেষ্টা চালালেও পুরোপুরি সফল হওয়া যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই সামাজিক সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছেন, কিন্তু তা এখনো পর্যাপ্ত নয়।
এই বাস্তবতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ দিয়ে পাখি শিকার বন্ধ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন দেশব্যাপী সমন্বিত প্রতিরোধ। দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য এমনিতেই নানামুখী চাপে নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। পাখি নিধন চলতে থাকলে এই পরিবেশ আরও দ্রুত ধ্বংসের পথে এগোবে, যার প্রভাব শেষ পর্যন্ত মানুষের ওপরই পড়বে। তাই এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধতা রক্ষা করা যাবে না।
সম্প্রতি ঢাকার পাশের একটি এলাকায় পাখি পর্যবেক্ষক, আলোকচিত্রী ও প্রশাসনের সমন্বয়ে পাখি শিকারের বিরুদ্ধে একটি সচেতনতামূলক কর্মসূচি আয়োজন করা হয়। এতে সাধারণ মানুষের ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। এ ধরনের উদ্যোগ যদি শীত মৌসুমজুড়ে দেশব্যাপী নেওয়া যায়, তাহলে ধীরে ধীরে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে এবং শিকার কমে আসবে। দীর্ঘমেয়াদে একটি সুস্থ, পাখিসমৃদ্ধ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই হওয়া উচিত সবার লক্ষ্য।



